রাবেয়া খাতুন Professor Rabeya Khatun Biography 1935-
'রাবুর হাতের লেখা পত্রিকা অফিসের পরপুরুষেরা দেখে, এজন্য আমাকে গঞ্জনা সহিতে হয়' এরকম একটি চিঠি একদিন এসে হাজির রাবু অর্থাত্ রাবেয়া খাতুনের বড় বোনের শ্বশুর বাড়ি থেকে। সময়টা ১৯৪৮-৪৯ সাল। রাবেয়া খাতুনের দু'চারটে গল্প ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি কাগজে ছাপা হয়েছে। কিশোরী রাবেয়ার চোখে স্বপ্ন লেখক হবার। স্বপ্নটা যখন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে, তখন হুট করে এমনি একটা চিঠি এসে তাঁকে কি দমিয়ে দিতে পেরেছিলো? পারেনি৷ মা-বাবার হাজারো আপত্তির দেয়াল টপকে সেদিনের রাবু আজ রাবেয়া খাতুন হতে পেরেছেন৷ সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ আমাদের দেশের খ্যাতিমান কথা সাহিত্যিক। রাবেয়া খাতুন : স্বনামধন্য সেই নাম, যাঁকে এখন প্রতিষ্ঠানতুল্য ভাবতে পারি সহজেই৷ ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তিনি যেমন স্নিগ্ধ অমায়িক, তেমিন কথাশিল্পী হিসেবেও তাঁর বিশাল সৃষ্টি-ভান্ডার কোমল জ্যোত্স্নার লাবণ্যে উদ্ভাসিত৷ আমাদের কথা সাতিহ্যের অঙ্গনে তাঁর বিচরণ প্রায় অর্ধ-শতাব্দীকালেরও বেশি৷ এই দীর্ঘ সময়ে তিনি আমাদের গদ্যসাহিত্যকে এতটাই দিয়েছেন, যার দীপ্তিতে তাঁর আপন ভূবন তো বটেই আমাদের সাহিত্য অঙ্গনও বিকশিত হয়েছে৷ আমাদের সাহিত্যও তাঁর বিশাল খ্যাতি আর নিরন্তর কমর্মুখরতার প্রতিদান হিসেবে তাঁকে সাহিত্যের একটি বড় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দিয়েছে৷ শত ছোটগল্পের কুশলী স্রষ্টা তিনি, বহু সাথর্ক নাটকের দশর্ক-শ্রোতা নন্দিত নাট্যকার, এক হাজার সত্তরটি উপন্যাস, একুশটি ভ্রমণকাহিনী আর ছোটদের জন্য লেখা উজ্জ্বল একগুচ্ছ গল্প-উপন্যাস মিলিয়ে তাঁর খ্যাতির চেয়েও তাঁর সৃষ্টিভান্ডার অনেক সমৃদ্ধ৷ সাহিত্য সাধনার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি একুশে পদকসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি৷ বাংলা একাডেমী পুরস্কারসহ সে তালিকা বেশ দীর্ঘই৷ কিন্তু সবচেয়ে বড় যে পুরস্কার তিনি অর্জন করেছেন, তা হলো অগণিত পাঠকের ভালোবাসা৷ এর কারণ সম্ভবত তাঁর লেখার স্বাদুগুণ৷ ভাষার প্রাঞ্জল গতি আর গল্প কাঠামোর শক্ত বুনন তাঁর রচনাকে কখনো জটিল করেনি বরং করেছে চিত্তগ্রাহী৷ আটচল্লিশ সালে যিনি কলম ধরেছিলেন কঠিন প্রতিকূল পরিবেশে, তিনি আজো সযত্নে ধরে আছেন সেই কলম৷ কলমকে তিনি ভালোবেসেছিলেন আর সেই ভালোবাসা আজও অম্লান আছে৷ পঞ্চাশের দশক থেকে এখন পর্যন্ত এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় রাবেয়া খাতুনের কলম থেকে অবলীলায় ঝরে পড়েছে শব্দ আর কথামালা৷ এই সব শব্দ আর কথামালা আমাদের নিয়ে গেছে কখনো সাহেব বাজারে, কখনো মধুমতীতে, দিবস রজনী, বায়ান্ন গলির এক গলিতে, নীল পাহাড়ের কাছাকাছি, ফেরারী সূর্যের কাছে৷ আবার কখনো নীল নিশীথে মোহর আলী কিংবা একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর সঙ্গে তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন আমাদের৷ পাপী পাথর ঠুকে ঠুকে জীবনের অন্বেষা করেছেন তিনি বারবার৷ এই অনন্ত অন্বেষাই যেনো রাবেয়া খাতুনের জীবনের আরেক নাম৷ তারপরও আছে মালিনীর দুপুর, রঙিন কাঁচের জানালা, দূরে বৃষ্টি, মেঘের পর মেঘ, শহরের শেষ বাড়ি, যা হয়না, জাগতিক, নষ্ট জ্যোস্নার আলো, সমুদ্র বন ও প্রণয় পুরুষ, ঠিকানা বি এইচ টাওয়ার, কুয়াশায় ঢাকা নগরবধূ, শংখ সকাল প্রভৃতির মতো আধুনিক কালের সঙ্গে মিল খাওয়া উপন্যাস।
If you cannot view the fonts properly please download and Install this file.
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
রাবেয়া খাতুনের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর তত্কালীন ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে মামার বাড়ি পাউসার গ্রামে৷ তাঁর পৈতৃক বাড়ি শ্রীনগর থানার ষোলঘর গ্রামে৷ বাবা মৌলভী মোহাম্মদ মুল্লুক চাঁদ, মা হামিদা খাতুন৷ বাবা ছিলেন সরকারি কর্মচারী আর দাদা ছিলেন শখের কবিরাজ৷
শৈশবকাল
পুরান ঢাকার রায় সাহেব বাজারের অলি-গলিতে ও যুক্ত বাংলার অন্যান্যশহরে কেটেছে শৈশবকাল৷ মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ি গিয়েও বেড়াতেন পরম আনন্দে৷ রাবেয়া খাতুনের ভাষায় "আমার কবিরাজ দাদা নৌকা করে দেবী দর্শনে নিয়ে আসতেন তার তৃতীয় প্রজন্মকে৷ ষোলঘর থেকে শ্রীনগর যাতায়াত বড় কষ্টের৷ এমন কিছু দূরে নয়৷ কিন্তু পুরো তল্লাটের পানি দখল করে থাকতো কচুরি পানায়৷ এই পানা ঠেলে প্রতিমা দেখতে যাওয়া চাট্টিখানিক বিষয় নয়৷ কাকারা বলতেন আধখানা প্রাণ নাকি বেরিয়ে যেতো৷ বিশেষ করে আমার মাস্টার কাকা হাফিজ উদ্দিন আহমদ (ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক) খুব গাঁইগুঁই করতেন বৈঠা টানতে৷ কিন্তু সেকালের কিশোর তরুণদের পিতার ইচ্ছায় বাধা দেয়ার কোন ক্ষমতা থাকতো না৷ তো কাকারা যত কষ্টই করুন আমরা থাকতাম দারুন আনন্দে৷ হ্যাজাক বাতিতে বাতিতে রাত হয়েছে দিন৷ গান বাজনা৷ মিষ্টি, মুড়কি ভাজা আরও কত কি৷ দাদা ধুতির (তখনকার মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের বাইরের পোশাক) প্রান্ত কিংবা আদ্দির পাঞ্জাবির পকেট থেকে দু পয়সা এক পয়সা করে আমাদের হাতে দিতেন ইচ্ছামত খরচ করার জন্য (এ প্রাপ্তির কোন তুলনা নেই)৷ একে নতুন ফ্রক স্যান্ডেল পেয়ে খুশি তার ওপর ঝকঝকে তামার পয়সা৷ আমি খাবার নয় খেলনা কিনতাম৷ পুতুলে জন্য ছিল একচোখা আসক্তি৷ একটু বেশি চঞ্চল ছিলাম বলে নৌকা চলার সময় ধানগাছ ধরে ফেলতাম৷ পাতার ধারে হাত কেটে রক্ত ঝরতো ৷ মা বকুনি দিতেন৷ ওই পানি থেকেই কি এক লতা দাঁতে চিবিয়ে প্রলেপ লাগাতেন৷ কচুরিপানার জলপথ পার হবার সময়ও সেগুলো স্পর্শ করতাম৷ করে বুঝেছি ওরা নিরাপদ৷ আর ফুলের যে রঙ সে বুঝি তুলনাহীন৷ বাবা ছিলেন অতি সুকন্ঠের শখের গাইয়ে এবং মাছ ধরার ওস্তাদ৷ নগর জীবনে যে সুযোগটি ছিলনা তা পূরণ হতো গ্রামে এসে৷ এই মত্স্য শিকারের সঙ্গে আমি তো থাকবোই৷ ঘন কচুরিপানার দুর্লভ চোয়ান স্থানটিতেই কাজটি হতো৷ কিন্তু চুপচাপ নৌকার খোলে পুতুলের মতো বসে থাকা আমার স্বভাবে নেই৷ প্রায়ই নৌকা নাড়াচাড়া দিয়ে বিস্তর বকুনি খেয়েছি৷ তারপরও বাবা আমাকেই সঙ্গে নিয়ে গেছেন৷ কারণ আমি থাকলে নাকি মাছ ঘন ঘন টোপ গেলে!"
শিক্ষা জীবন
রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে হওয়ায় স্কুলের গন্ডির পর তাকে কলেজ যেতে দেয়া হয়নি৷ স্কুলেই মুসলমান ছাত্রীদের সংখ্যা ছিল খুবই কম৷ কারণ সমাজের প্রচলিত নিয়ম ভেঙে মেয়েরা তখনো স্কুলে আসতে পারতো না বললেই চলে৷
কর্মজীবন
রাবেয়া খাতুন এক সময় শিক্ষকতা করেছেন৷ সাংবাদিকতার সঙ্গেও দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন৷ ইত্তেফাক, সিনেমা, খাওয়াতীন পত্রিকা ছাড়াও তাঁর নিজের সম্পাদনায় পঞ্চাশ দশকে বের হতো 'অঙ্গনা' নামের একটি মহিলা মাসিক পত্রিকা৷ বর্তমানে লেখালেখির কাজে নিবেদিত রয়েছেন৷
মধুমতী নিয়ে কিছু কথা
রাবেয়া খাতুনের প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থের নাম 'মধুমতী'। তাঁর ভাষায় "আমার প্রথম প্রকাশিত বই এর নাম মধুমতী। কথা বিতান থেকে ছাপা হয় ১৯৬৩-এর ১ জুলাই। মধুমতী না হয়ে আমার প্রথম বইয়ের নাম হতে পারতো ডায়মন্ড কাটা কাঁকন, রাজাবাগ অথবা আরেক জীবন৷ হতে পারতো এ জন্য বলছি তখনকার ইনল্যান্ড প্রেস প্রকাশনা সংস্থা থেকে আমার একটি ছোট গল্পের সংকলন বের করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এদের প্রকাশিত প্রথম বই ছিলো কবি আহসান হাবীবের রাত্রি শেষ (দ্বিতীয়-সংস্কারণ) ও জহীর রায়হানের গল্পগ্রন্থ সূযর্গ্রহণ৷ বই দুটি সুন্দর ছাপা এবং ঝকঝকে প্রচ্ছদের৷ এমনি একটি বই আমারও বেরুবে ভাবলেও ভালো লাগতো।
যথাসময়ে পান্ডুলিপি প্রেসে গেল। এক দুই করে ছাপা হয়ে চললো সাত ফর্মার পুরো বই। কভার করছে কাইয়ূম চৌধুরী। ছাপা ফর্মা নিয়ে গেছে বাইন্ডার। রোজ সকালে ভাবছি যে কোন দিন আত্মপ্রকাশ করবে আমার প্রথম বইটি৷ পত্র-পত্রিকার ছড়িয়ে থাকা গল্প উপন্যাসের লেখক থেকে আমার নতুন পরিচয় হবে গ্রন্থকারের৷ কিন্তু বাস্তবে সে সকাল আর আসে না। কভার হাতে, ছাপাতে দেরী হচ্ছে। এদিকে প্রকাশকের দিক থেকে দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক কিছু সমস্যা। সুতরাং সম্পূর্ণ বই ছাপা হয়েও পড়ে থাকলো বাইন্ডারের ঘরে। এই পড়ে থাকার সময় সীমা কয় মাস ছিলো স্পষ্ট মনে নেই। মনে আছে অনিবাযᐂ কারণে ঢিলে দেবার দাম প্রকাশককে দিতে হয়েছিল চড়া অংকে। কভার ছাপার পর বইয়ের খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেলো বাইন্ডার সের দরে সব কাগজ বিক্রি করে দিয়েছে। এই সংবাদ আমার কাছে যখন পৌঁছালো, তখন ফাইল কপিটা হাতের কাছে ছাড়া দ্বিতীয় সান্ত্বনা কিছু ছিলো না। প্রথম বই প্রকাশের পরম দুঃখ হিসেবে ছাপা সাত ফর্মা এখনও আমার কাছে রয়েছে। ইনল্যান্ড প্রেস ওই ক্ষতি পূরণের জন্য আবার আমারই একটি বই এ হাত দিলো। এবারে গল্প নয় উপন্যাস 'রাজাবাগ'। ওয়াইজঘাটের কোনও একটি প্রেসে কাজ চলছে। নতুন উত্সাহে প্রুফ দেখছি। দু'ফর্মা ছাপা হবার পর হঠাত্ গেলো কাজ বন্ধ হয়ে। কারণ কাগজ সংকট৷ সেই যে কাজ থামলো, চাকা আর ঘুরলো না। গড়িয়ে গেলো মাস, বছর। গাফফার চৌধুরী তখন মাসিক মোহাম্মদীতে। গল্পের জন্য প্রায়ই বাসায় আসতেন। কথা প্রসঙ্গে একদিন উঠলো ওই ব্যাপার দুটো। মনে মনে আমি বেশ হতাশ। তিনি গলায় জোর দিয়ে বললেন, আপনার বই কেনো বেরুবে না, নিশ্চয় বেরুবে। আমি প্রকাশক নিয়ে আসবো। সত্যি সত্যি নিয়ে এলেন এক ভদ্রলোককে। সাধারণত: পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেন মাঝে মধ্যে গল্প উপন্যাস। আমার হাতে তখন আমার লেখা দ্বিতীয় উপন্যাস 'আরেক জীবন'। লেনদেন সম্পর্কে কথা উঠতেই মুখের হাসিতে টান পড়লো। যাবার আগে বলে গেলেন সামনের সপ্তাহে তিনি আবার আসবেন। কাগজপত্র এবং এ্যাডভান্স নিয়ে। তারিখ মতো গাফফার চৌধুরী এলেন। কিন্তু প্রকাশক এলেন না। আমরা দুজনে তার জন্য বসে আছি। বিকেল গিয়ে সন্ধ্যা হলো। নিজেদের ভেতর আলাপ আলোচনায় যোগফল যেটা বেরুলো সেটা হচ্ছে পারিশ্রমিক দাবি করাটাই হয়েছে কাল। নিজের ওপর বিরক্ত হলাম। কেন আমার দাবি জোরদার করেছিলাম? সে যা বলেছিল রাজী হয়ে গেলেই তো পারতাম। বই বেরুনো দিয়ে কথা। কিন্তু অন্য একটা মন এমনিতে ফোঁস ফোঁস করে চললো- না হয়, না বেরুলো বই। বিনা পারিশ্রমিকে এতিমের মতো ছেড়ে দেব বই ? তৃতীয় বারের এই ঘটনার পর বই বেরুনোর আশা সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় রইলো না। এর মধ্যে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশ হয়ে গেলো 'মধুমতী', 'মন এক শ্বেত কপোতী', 'সাহেব বাজার'। কিশোর উপন্যাস 'দুঃসাহসিক অভিযান'। বাষট্টির শুরুর দিকে গুলিস্তানে কি একটা ছবি দেখতে গিয়ে লবিতে দাঁড়িয়ে আছি। এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিলেন নাম মোস্তফা জামাল। নতুন প্রকাশনা কথাবিতান থেকে আমার একটি উপন্যাস প্রকাশে আগ্রহী তিনি। কথাবিতান প্রকাশনা ক্ষেত্রে সদ্য আগত হলেও দু'চারটা বই যা বেরিয়েছিলো সুউন্নত মান ও সুরুচির জন্য বাজারে বেশ হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলো। সে সময় মুদ্রণ সংকট, কাগজ সংকট নানা রকমের অসুবিধার মধ্যে চোখে ধরার মতো পুস্তক প্রকাশ চাট্টিখানি কথা ছিলো না। বিশেষ করে একটি নবাগত সংস্থার জন্য তো রীতিমতো দুরুহ কর্ম। আমি ডাকিনি আপনা থেকে এসেছেন। নিজের ওপর এ যেন এক ধরনের বিশ্বাস ফিরে আসা। সানন্দে সম্মতি জানালাম। মনের ভেতর তবু খুঁতখুঁতি কড়কড় করে। কোন বৈরী সময় সন্দেহের সৃষ্টি করে হঠাত্ পাওয়া সৌভাগ্যকে। কিন্তু কয়েকদিন পর সত্যি সত্যি তিনি এলেন। নিয়ে গেলেন মধুমতীর ছাপা কপি। সংশয়ের দোলা তবু যায় না। প্রকাশক পান্ডুলিপি নিয়ে যাওয়া মানেই বই বেরিয়ে যাওয়া নয়। মাঝে মধ্যে বিপত্তির যে তিক্ত বাঁকগুলো রয়েছে, তার কিছু স্বাদ ইতোমধ্যেই তো পাওয়া হয়ে গেছে। সুতরাং যতোটা সম্ভব নির্বিকার থাকার চেষ্টা করছি। এর ভেতর কয়েক মাসের জন্য চলে যেতে হয় পশ্চিম পাকিস্তান। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ চিঠিপত্রে। এর মধ্যে যে চিঠিটা এখনও উজ্জ্বল, সেটা মধুমতীর প্রকাশকের চিঠি। জানিয়েছেন খুব শিগগিরই বইটি প্রেসে যাচ্ছে। করাচীর ধুসর প্রকৃতি সেই মুহূর্তে আমার চোখে সবুজে সবুজময় হয়ে গিয়েছিলো।
ঢাকায় ফিরলাম বাষট্টির জুলাই মাসে। ভেবেছিলাম হয়তো ছাপার কাজ শুরু হয়ে গেছে দেখি তা হয়নি। প্রকাশক বললেন খুব শিগগিরই শুরু হবে। হতে হতে সময় গড়ালো নভেম্বরে। প্রথম প্রুফ পেলাম ওই মাসের মাঝামাঝি। দিনটা রোমাঞ্চকর হতে পারতো। কিন্তু দাগ খাওয়া চৈতন্যের পুরোটা তখনও সন্দেহের ছায়ায় মলিন। মোস্তফা জামাল সাহেব প্রতিটি ফর্মা ছাপা হবার আগে নিজে নিয়ে আসতেন। ভুল ত্রুটি থাকলে জানতে চাইতেন। বইটি যাতে সবাᐂঙ্গ সুন্দর হয়ে বাজারে বেরুতে পারে এতে তাঁর সদিচ্ছার অভাব ছিলো না। মুস্কিল হলো কাগজ সঙ্কট নিয়ে। প্রায়ই শুনতাম ওই কারণে তৈরি ফর্মা বসে আছে। প্রচ্ছদের পরিকল্পনা চলছিলো। প্রকাশকের ইচ্ছে আমার বই মহিলা শিল্পীর হাতে আকাঁ প্রচ্ছদ দিয়ে বেরুলে এক ধরনের অভিনবত্ব হবে। যে কারণেই হোক শেষ পর্যন্ত তাঁর এ আশা পূর্ণ হয়নি। জনৈক উঠতি প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীর পেছনে কয়েক দিন ঘুরে শেষ পযর্ন্ত যাকে ঠিক করলেন তার কভার দেখে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। প্রকাশক তখন নিয়ে এলেন শিল্পী আশীষ চৌধুরীকে। আলোচনা হলো প্রচ্ছদ এবং অঙ্গসজ্জার বিভিন্ন দিক নিয়ে। 'মধুমতী'র পটভূমি চির অবহেলিত মুসলিম তাঁতী সম্প্রদায়। এক সময় যাদের পূবᐂপুরুষদের শিল্প কর্মের গৌরবঘ্রান ইউরোপ পর্যন্ত প্রসারিত ছিলো, কালে কালে সামাজিক, মানসিক, অর্থনৈতিক অবস্থানের কোন সীমানায় তারা পৌঁছেছিল। একদার প্রধান নদী মধুমতীর ধারা দূবর্ল৷ বর্তমান রূপান্তরের মতো তার দুপাড়ের বাসিন্দারা, একদার মসলীন, আরারোয়ান, শবনামের সু কারু শিল্পীরা দারিদ্রে ধুঁকছে। নিন্দিত হচ্ছে কারিগর বদনামে, সমাজের চোখে বিকৃত ছোট জাত হিসেবে। বলা হয়ে থাকে ইসলামে জাতি বিভেদ নেই। বাস্তবে ঠিক তার উল্টো৷ কারিগরদের অপাংক্তেয় করে রাখা হয় সম্ভ্রান্ত সমাজে। অন্য দিকে সামাজিক মর্যাদা সম্পন্ন সেই সম্ভ্রান্তরাই শহরে তাঁতের বিশাল ব্যবসা চালিয়ে কিনছে শিল্পপতির সুনাম। তাঁতী সম্প্রদায়ের এক জোড়া শিক্ষিত তরুণ-তরুণী রুখে দাঁড়ায় বিরুদ্ধবাদে। জাত নিয়ে তাদের সংকোচ নেই৷ আছে ঐতিহ্যবাহী গবᐂবোধ...
ঠিক হলো প্রতি পরিচ্ছেদের মাঝে মাঝে দেয়া হবে মসলীনের রকমারী নকশাদার ছোট ছোট কারুকাজ। প্রচ্ছদ হবে চার রঙা। প্রকাশকের ইচ্ছা খরচ যতোই হোক বইটি হওয়া চাই হাতে ধরার মতো, দুবার তাকিয়ে দেখার মতো৷ মনে মনে আমার আশাটাও তাই৷ বই এর বাজারে বই কিনতে গিয়ে স্টলগুলোতে যখন দেখি কলকাতার বইয়ের পাশে আমাদের বই গুলো কি মারাত্মক ম্লান। দীনহীন ওই চেহারা মনকে তখন ছোট করে, চোখকে পীড়িত করে। কিছুতেই ভাবতে পারিনা আমার বইটিও অমনি প্রচ্ছদের মলিন পোশাক পরে গরীব অস্তিত্বে দাঁড়িয়ে থাকবে। দুটো কভার নিয়ে আশীষ চৌধুরী এলেন। একটি পছন্দ হলো। কিন্তু শিল্পীর আকাঁর পরও ছাপার একটা ব্যাপার থাকে। রাজ্যের দুশ্চিন্তা তা নিয়ে। হয়ত প্রায় অনর্থক মানসিক হয়রানি। জুলাইয়ের পহেলা তারিখে ওই হয়রানি থেকে মুক্তি পেলাম। দশ ফমাᐂর মধুমতী চার রঙা প্রচ্ছদ ও সুচারু অঙ্গ সজ্জায় রীতিমতো আকর্ষণীয়। ডিমাই সাইজ দাম সাড়ে তিন টাকা। এদেশী পুস্তক সংক্রান্ত বুক স্টলের যে দিকটা আহত করতো, সেদিক থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারলাম সাথে সাথে আনন্দেরও। প্রথম যখন লিখতে শুরু করি তখন স্বপ্ন দেখতাম প্রথম বই উত্সর্গ করবো আমার লেখক জীবনের প্রথম ও একমাত্র পাঠক ছোট বোন সুফিয়াকে। বহুদিনের লালিত সাধ মধুমতী প্রকাশে পূরণ হলো। বইটি হাতে পেয়ে এক ধরনের শক্তিশালী বিশ্বাসে দীপ্ত হয়ে উঠেছিলাম - সত্যি সত্যি বই বেরুলো৷ গ্রন্থকারের তালিকাভুক্ত হলাম আমি।"
পারিবারিক জীবন
রাবেয়া খাতুনের বিয়ে হয় ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই৷ স্বামী-এটিএম ফজলুল হক (চিত্র পরিচালক), চার সন্তানের জননী। প্রথম সন্তান ফরিদুর রেজা সাগর ১৯৫৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জন্ম গ্রহণ করেন। কেকা ফেরদৌসীর জন্ম ১৯৬০ সালের ৪ আগস্ট৷ ফরহাদুর রেজা প্রবাল ১৯৬২ সালের ৩১ মার্চ ও ফারহানা কাকলী ১৯৬৪ সালের ২৫ অক্টোবর জন্ম গ্রহণ করেন।
ক্ষেত্রভিত্তিক অবদান
শিল্প-সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন থেকে জড়িত৷ বাংলা একাডেমীর কাউন্সিল মেম্বার। জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের গঠনতন্ত্র পরিচালনা পরিষদের সদস্য, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরীবোর্ডের বিচারক, শিশু একাডেমীর কাউন্সিল মেম্বার ও টেলিভিশনের 'নতুন কুড়ি'র বিচারক। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জাতীয় বিতর্কের জুরীবোর্ডের বিচারক ও সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। যুক্ত আছেন বাংলা একাডেমী, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, ঢাকা লেডিজ ক্লাব, বিজনেস ও প্রফেশনাল উইমেন্স ক্লাব, বাংলাদেশ লেখক শিবির, বাংলাদেশ কথা শিল্পী সংসদ ও মহিলা সমিতির সঙ্গে। রাবেয়া খাতুনের কাহিনী নিয়ে চারটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। প্রথম চলচ্চিত্র ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম কিশোর চলচ্চিত্র, ১৯৬৪ সালে এটি নির্মিত হয়। বহু বছর তিনি আর চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহী হননি। এর কারণ সেই সময় যারা চলচ্চিত্র করতে চাইতেন তারা বলতেন শুধু চলচ্চিত্রের জন্য কাহিনী নির্মাণ করতে কিন্তু তিনি তাতে রাজী ছিলেন না। তাঁর লেখা পুর্ণাঙ্গ হতো গল্প বা উপন্যাসে। কোন কিছুকে লক্ষ্য রেখে তিনি লিখতে পারতেন না, আর এই কারণেই বহু বছর চলচ্চিত্র থেকে দূরে থেকেছেন। চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় ২০০৪ সালে মেঘের পর মেঘ চিত্রায়িত হয়৷ এটি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছিল। মৌসুমী পরিচালিত কখনও মেঘ কখনও বৃষ্টি মুক্তি পায় ২০০৩ সালে। এটি একটি সামাজিক প্রেক্ষাপট নির্ভর চলচ্চিত্র। এর পর ২০০৫-এ মুক্তি পায় ধ্রুবতারা। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন চাষী নজরুল ইসলাম। এটি 'মহাপ্রলয়ের পর' উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হয়েছে।
কিছু গল্প কিছু স্মৃতি
রাবেয়া খাতুনের দীর্ঘ বনার্ঢ্য কর্মময় জীবনে বহু স্মৃতি রয়েছে। তাঁর ভাষায় "আমার জন্মের সময় কৌতুককর যে ঘটনাটি ঘটে সেটি ছিল একই সঙ্গে বাবার জন্য আনন্দ ও হতাশার। সেকালে জামাইরা পিঠে খাবার দাওয়াত পেতেন শ্বশুরবাড়ি থেকে। ঘটা-করা ব্যাপার ছিল সেটা। আমন্ত্রিত বাবা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে খুশি মনে দাওয়াত রাখতে গেছেন। কিন্তু থাকা হলো না। বাবা গেলেন বৃহস্পতিবার আমি এলাম শুক্রবার সকালে। সেই সময় কন্যাসন্তান জন্মালে পরিবার খুশি হতো না। আমার বেলা হলো উল্টো। গ্রাম্য প্রবাদ ছিল 'নিকাই ঘরে হয় ঝি, পান্তা ভাতে ঢালে ঘি'। অর্থাৎ দ্বিতীয় পক্ষে প্রথম কন্যা সন্তান পিতার জন্যে বয়ে আনে সৌভাগ্য । বাবার প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর আমার মায়ের সাথে বিয়ে হয়। বাবা বেশির ভাগ সময় ঢাকায় চাকরি করেছেন। কিন্তু আমার জ্যাঠা সব সময় পশ্চিমবঙ্গে চাকরি করেছেন এবং আমার জীবনের প্রথম নায়ক যদি বলি (নায়ক মানে যিনি বীরের মতো কাজ করেন) অর্থাত্ আমার কাছে যদি আমার দেখা প্রথম নায়কের কথা জিজ্ঞেস করা হয় আমি বলব আমার জ্যাঠার কথা৷ জ্যাঠা অতি সাহসী ব্যক্তি ছিলেন। পরে অত্যন্ত দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছেন।
আমার বয়স যখন পাঁচ কী ছয় তখন আমরা থাকতাম পুরানো ঢাকার রায়সাহেব বাজারের নাসিরুদ্দিন সর্দার লেনে। শোবার ঘরের ছিল একটা জানালা। জানালার বাইরে খানিকটা আকাশ। একটি বিশাল সজনে গাছ। মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে চোখ মেলেই দেখতাম, বাবা জানালার ধারে নামাজের ভঙ্গিতে বসে ভায়রো রাগে গান গাইছেন। শুনতে শুনতে আবার ঘুমিয়ে যেতাম কিন্তু এই ছবিটি সারাজীবন আমার স্মৃতির ভেতর প্রাণবন্ত হয়ে আছে। ছোটবেলায় গান শিখতাম কিন্তু নিয়মিত রেওয়াজ করতে পারতাম না। কারণ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। গানকে ভালো চোখে দেখা হতো না। আমাদের বাসাটি ছিল মসজিদ লাগোয়া। তাই হারমোনিয়াম বাজানো ছিল নিষিদ্ধ। প্রায় দিনই খালি গলায় গাইতাম। যেদিন আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামতো সেদিন হারমোনিয়ামের সঙ্গে প্র্যাকটিস করতাম। বাবা বাজাতেন, আমি আর আমার ছোট বোন সুফিয়া গাইতাম। গান আমার প্রাণ, মৃত্যু অব্দি তা আমার সঙ্গেই থাকবে। পুরনো ঢাকায় আমার থাকা হয়েছে প্রায় ১০ বছর। এর মধ্যে বাবা এ শহর সে শহর বদলি হয়েছেন৷ বেশিরভাগ সময় কেটেছে ঢাকার বিভিন্ন ভাড়াটে বাসায়। তখন দামি বাড়ির ভাড়া ছিল বার থেকে একুশ টাকা। এইসব বাড়িতে চার পাঁচটা ঘর থাকতো। এছাড়াও আরো থাকত বড় আঙিনা, নিজস্ব ট্যাপ কল৷ এই কল ছিল গেরস্থের দামি সম্পদ। কারণ পুরো পাড়ায় সরকারি কল থাকতো মাত্র দু'টি (পুরুষ-মহিলা)। সকাল দশটায় পানি চলে যেত। সন্ধ্যায় আর একবার আসতো। আমরা থাকতাম বারো টাকার একটা বড় বাড়িতে। ১৯৩৯ সালে তখন ১০০ টাকায় পুরো সংসার ভালো ভাবেই চলে যেত। তখন সরু চালের মন ছিল ৪ টাকা, খাসি, মুরগি, মাছ, পোশাক সবকিছুর দামই ছিল কম। আমাদের আশপাশের অধিকাংশ লোকজনই ছিল আদিবাসী মানে মূল 'ঢাকাইয়া'। প্রতিবেশীদের বাসায় যাওয়া আমাদের জন্য নিষেধ ছিল। কিন্তু আমি এসব নিষেধাজ্ঞার ভেতর দিয়েও সব বাসায় যেতাম। এ জন্য অনেক বকুনি শুনতে হতো। পুতুল খেলার প্রতি আমার খুব ঝোঁক ছিল। সাধারণত মেয়েরা আট দশ বছরেই পুতুল খেলা ছেড়ে দেয়। আমি বারো বছর বয়স পর্যন্ত খেলেছি। শুধু পুতুল বিয়েই দিতাম না, বায়োস্কোপে দেখতাম নায়িকা নার্সের ভূমিকায় অভিনয় করছে। আমি আমার পুতুলদের দিয়ে নার্স, ডাক্তার, হাসপাতাল সবই বানাতাম। আমার পুতুল খেলা তাই একটু ভিন্ন ছিল। আরেকটা খেলা খেলতাম সেটা হল সিনেমার বইয়ের ছবি কেটে কেটে গল্প বানাতাম। আমার খাতার ভেতরই এসব করতাম। এজন্য আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হতো। যেমন আমি একবারের কথা বলি। আমার গল্প বানাতে একটা টিউবয়েলের ছবি দরকার। কিন্তু সেটা কোথায় পাব? খুব ঝামেলায় পড়ে গেলাম। পরে স্বাস্থ্য বই থেকে টিউবওয়েল কেটে লাগিয়ে দিলাম। সেই পূর্ণদৈর্ঘ্য বায়োস্কোপের দশর্ক মাত্র একজন - সুফিয়া।"
লেখালেখির হাতে খড়ি যেভাবে
রাবেয়া খাতুন ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। "আমার লেখার হাতে খড়ি হয় উপন্যাস দিয়ে৷ ঢাউস ঢাউস উপন্যাস (এখনো সংগ্রহে আছে কয়েকটা)। বাড়ির নিয়ম ছিল সপ্তাহে দু'টো বায়োস্কোপ বা টকি সিনেমা দেখা। আমার কাহিনী তৈরি হতো সম্ভবত সেই মাল-মসলায়। ভেতরে আমারই আঁকা ছবির ক্যাপশন থাকত। প্রথমটার নাম ছিল নিরাশ্রয়া, পরে বিদায়, অশোক-রেবা এই ধরনের নাম আর কি? মা দু'টো ব্যাপারে ভীষণ রেগে যেতেন। প্রায়ই তাঁর কাছে ধরা পড়ে যেতাম পাঠ্যপুস্তকের তলায় গল্পের বই নিয়ে। কখনো গল্প লিখতে গিয়ে। সব মায়ের মতো তাঁরও স্বপ্ন মেয়ে ক্লাসে ফার্স্ট হবে। আমাদের পড়াশুনা মূলত একটি ভালো বিয়ে দেওয়ার জন্যই করানো হতো। উঁচু গ্রেডে পাশ দূরে থাক, আমি টায়টায় পাশ করতাম। ছাত্রী হিসেবে মোটেও ভালো ছিলাম না। মা তার জন্য দায়ী করতেন বাইরের বই পড়া ও গল্প লেখার নেশাকে।"
বিয়ে নিয়ে মজার ঘটনা
জাহানারা ইমামের পাক্ষিক পত্রিকা খাওয়াতীন এ কাজ করতাম। এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মহিলা পত্রিকা৷ জাহান আপার সঙ্গে প্রেস শো দেখতে গিয়ে দূর থেকে দেখেছি সম্পাদক ফজলুল হককে। বাসার পরিস্থিতি তখন খুব খারাপ। বিয়ের কারণে আমার ওপর পরিবার রীতিমতো বিরক্ত। কোনো পাত্রই পছন্দ হয় না। আত্মীয় পরিজনরা হাসাহাসি করে, বলাবলি করে "ও হবে এদেশের বড় লেখিকা। আর ওর জন্য আকাশ থেকে আসবে রাজপুত্র।" সত্যি এলো রাজপুত্র তবে আকাশ থেকে নয়, জমিন থেকে। ফজলুল হক আর কাইয়ূম চৌধুরী তখন জুটি হিসেবে সাইকেলে ঘোরাফেরা করে৷ প্রথমজন চালক আর দ্বিতীয়জন রডে বসা আরোহী৷ প্রতিবেশী কাইয়ূম আমার বাড়ি চেনে৷ এক বিকেলে দু'জন এসে বাবার সঙ্গে আলাপ করে গেল। বাসা থেকে আমার ওপর এলো প্রবল চাপ৷ এরা কেনো এলো? আমি তো আসলেই কিছু জানি না। চিন্তাও করিনি এমন দুঃসাহস। জাহানারা ইমামের সঙ্গে প্রেস শো দেখতে গেছি প্রবোধ স্যান্নালের 'মহাপ্রস্থানের পথে' মায়া সিনেমা হলে। এক ফাঁকে ফজলুল হক আমার সঙ্গে কথা বলতে এলো৷ প্রস্তাব রাখল আমি যদি রাজি থাকি তবে বাবার কাছে বিয়ের বিষয় প্রস্তাব নিয়ে আসবে তার আত্মীয়জস্বজন। লম্বা, স্মার্ট, সুদর্শন এবং সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত যুবক। আপত্তি নেই জানিয়েছিলাম। দু'সপ্তার মধ্যে কাবিন হয়ে গেল। বাবা-কাকার মত ছিল না। চেনা জানা নেই, দূর দেশ (?) বগুড়ার ছেলে। কিন্তু ভীষণ খুশী হলো আমার মা। হকের বাড়িতে ওর বাবা ভাইবোন সবাই বেজায় খুশি। বেজার শুধু ওর মা কারণ তিনি স্থানীয় এক ধনী কন্যাকে ঠিক করে রেখেছিলেন। বায়ান্ন সালের তেইশে জুলাই আমাদের বিয়ে হয়। ঢাকায় সিক্কাটুলীতে বাসা নেয়া হলো। আমার বয়স তখন উনিশ, রান্নার র'ও জানি না। অবশেষে বাবুর্চি এলো। দশটায় খেয়ে-দেয়ে দুজনেই অফিসে চলে যাই। ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটের একটা বিশাল বাড়ির দোতালায় সিনেমা পত্রিকার অফিস। পত্রিকা চালায় মূলত তিনজন। ফজলুল হক, ওর ছোট ভাই ফজলুল করীম (এখন বিশ্ব বিখ্যাত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ), জহীর রায়হান ও কাইয়ূম চৌধুরী। ওদের সাথে যুক্ত হলাম আমি। পরিচিত হতে লাগলাম উদীয়মান সাহিত্য প্রতিভাদের সঙ্গে। এক কথায় সাহিত্যাঙ্গনের স্বপ্নের মানুষদের সঙ্গে।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস
মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে রাবেয়া খাতুন বলেন, "দেশ প্রেমিক অন্যান্য বাঙালির চেয়ে পৃথক কিছু নয়। তবে সেই সময়টাকে গল্প, উপন্যাস, নাটক ও স্মৃতিকথায় আজো আমি পারফেক্ট ভাবে ধরতে পেরেছি বলে মনে হয় না৷ প্রতিটি বাঙালির মতো 'যন্ত্রণা, লাঞ্ছনা, অভাব, কষ্ট' কিসের মুখোমুখি হতে হয়নি! এর মধ্যে হক চলে গেল বর্ডার পার হয়ে ওপারে। খুব স্বার্থপরের মতো লেগেছিলো বিষয়টা। তখন গৃহকর্তার ওপারে গেলে সেই অপরাধে বৌ-বাচ্চা ক্যান্টনমেন্টে চালান হয়ে যেতো। আমার বয়স কম, বাচ্চারা ছোট, হাতও বলতে গেলে প্রায় খালি, যে কোন সময় মহা বিপদ হতে পারতো। সেলটার হল সুফিয়া এবং আকবর। আকবর তখন ব্যাংকের অফিসার। থাকে বাসাবোর একটা বড় ফ্ল্যাটে। পাক-সেনারা সহজে ঐ সাইজের বাড়িতে এবং বেশি ভেতরের দিকে ঢুকতে সাহস করতো না। ঐ এলাকাটা ওরা খুব নিরাপদ মনে করতো না। ফলে বেঁচে যাওয়া। কিন্তু অর্থনৈতিক ব্যাপারে খুবই অসুবিধার মধ্যে কেটেছে। দু'বার ঢাকা থেকে পালিয়েছিলাম। শেষ বার ডিসেম্বরের বম্বিং এর পর। অনবরত দিনের বেলা পাকবাহিনী যেখানে সেখানে বোম ফেলছে। আমরা কখনও নৌকা কখনও মাইলের পর মাইল পায়ে হাঁটছি। শীতের রাত চষা ক্ষেতের শিশির ভেজা পিছল পথ। রাতে চাঁদের আলো ছিল। তবু একটা আধ ভাঙ্গা ব্রিজ থেকে নিচে পড়ে গেলাম। নদী বাঁধের জন্য চোখা চোখা বাঁশ দাঁড় করানো। যদি বাঁশে গেঁথে যেতাম তাহলে সে রাতেই জীবনের ইতি টানতো।"
স্মরণীয় ঘটনা
বাংলা একাডেমীর যে পুকুরটি রয়েছে প্রস্তাব আনা হলো সেটি থাকবেনা বন্ধ হয়ে যাবে৷ সাব-কমিটি করা হলো ড. শমসের আলী আর আমি৷ আমরা রিপোট করলাম থাকবে৷ এখন মনে হয় সিদ্ধান্ত যেভাবে নেয়া হয়েছিল কিজে কি হলো? পুকুরটি থাকবে, তবে যত্নে এবং সৌন্দর্যে সেটাকে আকর্ষক করা হবে৷ যা এখন পর্যন্ত করা হয়নি৷ একুশের মেলায় গেলে সেই কথাটা মনে হয়৷ এমন অবহেলিত, সৌন্দর্য বিবর্জিতভাবে ওটা থাকার চেয়ে না থাকাই বরং ভালো ছিল৷
জীবনের একটি সুখ এবং দুঃখের স্মৃতি
দু'টোই একসঙ্গে গ্রন্থিত। বাবার বয়স হয়েছিল কিন্তু একাত্তরের দুঃসময় না এলে তিনি মারা যেতেন না। আগস্টে ঢাকা থেকে পালিয়ে চলে গিয়েছিলাম গ্রামে। সেই ধকল তিনি সইতে পারেননি। অসুস্থ হয়ে কোমায় ছিলেন বারো দিন। নদীতে মিলিটারী টহলদাররা নৌকা আটকে রেখেছিল। ঢাকার ডাক্তাররা বললেন, অলরেডি তিনি মৃত। বিনা চিকিত্সায় মারা গেলেন বাবা। ভাবলে এখনো অপার অব্যক্ত কষ্টে ভুগি। একই সঙ্গে পুলকিত হই আমার উপার্জনের টাকায় বাবার কাফন-দাফন হয়েছিল ভেবে।
প্রথম প্রকাশিত লেখা
১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম প্রগতিশীল সাপ্তাহিক 'যুগের দাবীতে' ছাপা হয় ছোটগল্প 'প্রশ্ন'। ১৯৬৩ সালের ১ জুলাই পুস্তকাকারে 'মধুমতী' প্রথম বই হিসেবে প্রকাশিত।
পুরস্কার
সাহিত্য অঙ্গনে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন-
১৯৭৩, বাংলা একাডেমী এ্যাওয়ার্ড, বাংলা একাডেমী
১৯৮৯, হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার
১৯৯৩, একুশে পদক, বাংলাদেশ সরকার
১৯৯৪, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ
১৯৯৫, নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক
১৯৯৬, জসিমউদ্দিন পুরস্কার
১৯৯৬, শেরে বাংলা স্বর্ণপদক
১৯৯৬, শাপলা দোয়েল পুরস্কার
১৯৯৭, টেনাশিনাস পুরস্কার
১৯৯৮, ঋষিজ সাহিত্য পদক
১৯৯৮, অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার
১৯৯৯, লায়লা সামাদ পুরস্কার
১৯৯৯, অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার
২০০০, মিলেনিয়াম এ্যাওয়ার্ড
২০০১, টেলিভিশন রিপোটার্স এ্যাওয়ার্ড
২০০২, বাংলাদেশ কালচারাল রিপোটার্স এ্যাওয়ার্ড
২০০২, শেলটেক পদক
২০০৫, মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার
২০০৫, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি
ইউরো শিশু সাহিত্য পুরস্কার দুবার, চলচ্চিত্র সংস্থা থেকে একাধিকবার। এছাড়াও বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা থেকে একাধিকবার নারী বিষয়ক তাঁর মূল্যবান বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে। তাঁর ছোটগল্প অনুদিত হয়েছে ইংরেজী, উর্দু, হিন্দী ও ইরানী ভাষায়। ইংরেজীতে অনুবাদ হচ্ছে 'মধুমতী'। উপন্যাস-দু:সাহসী অভিযান চিত্রায়িত হয়েছিল 'প্রেসিডেন্ট' নামে। সেটি ছিলো পূর্বপাকিস্তানের প্রথম শিশু-কিশোর চলচ্চিত্র। ২০০৪ সালে চলচ্চিত্রে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস 'মেঘের পর মেঘ'। ছবিটি একাধিক পুরস্কারে পুরস্কৃত। ২০০৩ সালে মৌসুমী পরিচালিত কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি ও ২০০৫ সালে মুক্তি পায় ধ্রুবতারা।
দেশ ভ্রমণ
ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, সুইডেন, জাপান, নেপাল, ভারত, সিকিম, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মিশর, দুবাই, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, উজবেকিস্তান, মরিশাস, মালদ্বীপ, সুইজারল্যান্ড, হংকং। এছাড়াও টরেন্টো ইউনিভার্সিটি বাংলা বিভাগের আমন্ত্রণে ঘুরে এসেছেন কানাডায়।
শখ
গান শোনা, ছবি দেখা, নাটক দেখা, ছবি তোলা, ভ্রমণ। সাহিত্য ছাড়াও জ্যোর্তিবিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস বিষয়ক বই পড়তে তিনি পছন্দ করেন।
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ
উপন্যাস
মধুমতী, সাহেব বাজার, অনন্ত অন্বেষা, রাজারবাগ শালিমারবাগ, মন এক শ্বেত কপোতী, ফেরারী সূর্য, অনেকজনের একজন, জীবনের আর এক নাম, দিবস রজনী, সেই এক বসন্তে, মোহর আলী, নীল নিশীথ, বায়ান্ন গলির একগলি, পাখি সব করে রব, নয়না লেকে রূপবান দুপুর, মিড সামারে, ই ভরা বাদর মাহ ভাদর, সে এবং যাবতীয়, হানিফের ঘোড়া, হিরণ দাহ, মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সমগ্র, এই বিরল কাল, হোটেল গ্রীন বাটন, চাঁদের ফোটা, নির্বাচিত প্রেমের উপন্যাস, বাগানের নাম মালনিছড়া, প্রিয় গুলসানা, বসন্ত ভিলা, ছায়া রমণী, সৌন্দর্যসংবাদ, হৃদয়ের কাছের বিষয়, ঘাতক রাত্রি, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, মালিনীর দুপুর, রঙিন কাঁচের জানালা, মেঘের পর মেঘ, যা কিছু অপ্রত্যাশিত, দূরে বৃষ্টি, সাকিন ও মায়াতরু, রমনা পার্কের পাঁচবন্ধু, শুধু তোমার জন্য, ঠিকানা বি এইচ টাওয়ার, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, প্রথম বধ্যভূমি, কমলিকা, দশটি উপন্যাস, শঙ্খ সকাল প্রকৃতি, যা হয়না, আকাশে এখনো অনেক রাত, উপন্যাস সমগ্র, স্বনিবার্চিত উপন্যাস, জাগতিক, স্বপ্নে সংক্রামিত, ও কে ছিল, মহা প্রলয়ের পর, নির্বাচিত উপন্যাস, শহরের শেষ বাড়ি, নষ্ট জ্যোস্নার আলো, মাইগো, সমুদ্রবণ ও প্রণয় পুরুষ, এই দাহ, রাইমা।
গবেষণামূলক গ্রন্থ
জীবন ও সাহিত্য, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, স্মৃতির জ্যোর্তিময় আলোকে যাদের দেখেছি।
ছোটগল্প
আমার এগারোটি গল্প, মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী, নির্বাচিত ছোটগল্প, মধ্যরাতে সাত মাইল, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্পসমগ্র, লাল চিঠি, প্রেম কিংবা পরশ পাথর, তোমার কাছে যাব বলে, গল্প সমগ্র-এক, গল্প সমগ্র-দুই, গল্প সমগ্র - তিন, গল্প সমগ্র - চার।
স্মৃতিকথা
একাত্তরের নয় মাস, স্বপ্নের শহর ঢাকা, চোখের জলে পড়ল মনে।
ভ্রমণকাহিনী
হে বিদেশী ভোর, মোহময়ী ব্যাংকক, টেমস থেকে নায়েগ্রা, কুমারী মাটির দেশে, হিমালয় থেকে আরব সাগরে, কিছুদিনের কানাডা, চেরি ফোঁটার দিনে জাপানে, কুমারী মাটির দেশে অষ্ট্রেলিয়ায়, আবার আমেরিকা, মমি উপত্যকা এবং অন্যান্য আলোকিত নগর, ভূস্বর্গ সুইজারল্যান্ড, হংকং, মালদ্বীপ, পূবের ভূস্বর্গ সোয়াত, তাসমানিয়া।
কিশোর উপন্যাস
দু:সাহসিক অভিযান, সুমন ও মিঠুন গল্প, তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা, একাত্তরের নিশান, দূর পাহাড়ের রহস্য, লাল সবুজ পাথরের মানুষ, সোনাহলুদ পিরামিডের খোঁজে, চলো বেড়িয়ে আসি, রক্তমুখী শিলা পাহাড়, কিশোর উপন্যাস সমগ্র, সুখী রাজার গল্প, হিলারী যখন ঢাকায় আমরা তখন কাঠমুন্ডুতে, রোবটের চোখ নীল, ইশা খাঁ, ছোটদের উপহার৷
এছাড়াও সাহিত্য সংস্কৃতি পত্র 'সোনারং' রাবেয়া খাতুনকে নিয়ে প্রকাশিত করেছে বিশেষ সংখ্যা 'কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন'৷ সোনারং সম্পাদনা করেছেন রহমান মুস্তাফিজ।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment