| Home | Menu | Poems | Poets | Reading | Theme | Biography | Articles | Photo | Dictionary | Chat | Video | Shop | Extra | Jokes | Games | Science | Bio | বাংলা

আবু হেনা মোস্তফা কামাল Abu Hena Mustafa Kamal Biography 1936-1989



বহু পরিচয়ে বিশিষ্ট ছিলেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল ৷ তিনি ছিলেন একজন গীতিকার, কবি, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, অধ্যাপক, গায়ক, বাগ্মী ও টেলিভিশনের উপস্থাপক ৷ প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেন তিনি ৷

If you cannot view the fonts properly please download and Install this file.

জন্ম ও বংশপরিচয়

পাবনা জেলার পাবনা থানার গোবিন্দা গ্রামে ১৯৩৬ সালের ১৩ মার্চ আবু হেনা মোস্তফা কামালের জন্ম ৷ বাবা এম. শাহজাহান আলী ছিলেন প্রথম জীবনে স্কুলশিক্ষক, পরে কোনো অফিসের হেডক্লার্ক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহন করেন ৷ অকালেই মারা যান তিনি ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামালের মা খালেসুননেসা দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন ৷ গান ভালো গাইতেন ৷ ছেলেমেয়েদের মানুষ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামালরা ছিলেন তিন ভাইবোন ৷ সবার বড় বোন সাবেরা খাতুন শামসুন আরা ৷ সাবেরা খাতুনের স্বামী খ্যাতিমান সাংবাদিক কেজি মুস্তফা ৷ সেই সূত্রে সাবেরা খাতুন সাবেরা মুস্তফা নামেই পরিচিত ৷ সাবেরা মুস্তফা অধ্যাপক এবং মঞ্চ ও বেতারের অভিনেত্রী ছিলেন ৷ তাঁর পরে আবু হেনা মোস্তফা কামাল ৷ ভাইবোনদের মধ্যে ছোট আবুল হায়াত্‍ মোহাম্মদ কামাল ৷ বাংলাদেশ বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক ছিলেন ৷ গীতিকার হিসেবেও তিনি সুপরিচিত ৷

শিক্ষা

পাবনা জেলা স্কুল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাস করেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল ৷ ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ১৩তম স্থান অধিকার করেন তিনি ৷ ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ৭ম স্থান লাভ করেন ৷ ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেনতিনি ৷ একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৯ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন ৷ উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল ৷ পরে ১৯৬৯ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'দ্য বেঙ্গলি প্রেস অ্যান্ড লিটারারি রাইটিং (১৮১৮-১৮৩১)' শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি ৷

কর্মজীবন

আবু হেনা মোস্তফা কামালের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫৯ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে প্রভাষক হিসেবে ৷ তারপর চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজে কিছু দিন শিক্ষকতা করেন ৷ ১৯৬০ সালে যোগ দেন রাজশাহী সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগে ৷ দুই বছর সেখানে ছিলেন ৷ ১৯৬২ সালে তিনি প্রাদেশিক সরকারের জনসংযোগ বিভাগের সহকারী পরিচালক হয়ে ঢাকায় চলে আসেন ৷ ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ৷ একই পদে স্থায়ী নিয়োগ পেয়ে ১৯৬৫ সালে যোগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ৷ পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণার জন্য ১৯৬৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান তিনি ৷ সেখানে অধ্যাপক টিডব্লিউ ক্লার্কের তত্ত্বাবধানে 'দ্য বেঙ্গলি প্রেস অ্যান্ড লিটারারি রাইটিং' শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ৷ ১৯৭০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসার পর তিনি রিডার পদে উন্নতি লাভ করেন ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন ১৯৭৩ সালের ৫ অক্টোবর ৷ সেখানে ১৯৭৬ সালে অধ্যাপক হন আবু হেনা ৷ ১৯৭৮ সালে ফিরে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে, অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন তিনি ৷ ১৯৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক পদে যোগদান করেন ৷ ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি ৷

সংসার ও সন্তান

১৯৫৬ সালের ২৫ অক্টোবর হালিমা খাতুনকে (ডাক নাম টুলু, পরবর্তীতে হালিমা মোস্তফা) নিয়ে দাম্পত্যজীবন শুরু করেন ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও হালিমা মোস্তফা দম্পতির পাঁচ সন্তান ৷ সন্তানদের মধ্যে কাবেরী মোস্তফা (শিখা) কম্পিউটার প্রোগ্রামার, বর্তমানে সফট্ওয়্যার ব্যবসায়ী , কাকলী মোস্তফা (কেকা) ইতিহাসবিদ ও শিক্ষক, সুজিত মোস্তফা (বিদ্যুত্‍) আধুনিক, সেমি ক্ল্যাসিক্যাল ও নজরুল সঙ্গীতের খ্যাতিমান শিল্পী, শ্যামলী মোস্তফা (পাখি) চিকিত্‍সক, বর্তমানে মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত এবং সৌমী মোস্তফা (পিনু) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ সমাপ্ত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত আছেন ৷

মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশের মতোই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শিকার হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও৷ ওই সময় পাকিস্তানি বাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে হত্যা করে, কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়৷ আবু হেনা মোস্তফা কামালকেও তারা ধরে নিয়ে যায়৷ আবু হেনাকে অস্ত্রের মুখে রাজশাহী বেতার কেন্দ্র থেকে তাদের পক্ষে কথিকা লিখতে বাধ্য করে৷ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছু সহকর্মীর প্ররোচনায় পাকিস্তানের পক্ষে কথিকা লেখার দায়ে আবু হেনাকে গ্রেফতার করা হয়৷ সেটা ছিল ১৯৭২ সালের জানুয়ারি৷ অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য৷ খান সারওয়ার মুরশিদ, অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী, অধ্যাপক সালাউদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী তাঁকে মুক্ত করার জন্য ওই সময় সক্রিয় হয়েছিলেন৷ তাঁর ভগ্নিপতি সাংবাদিক কে. জি. মোস্তফার সুপারিশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরাসরি আদেশে তাঁকে দুই-তিন দিনের মধ্যে মুক্তি দেওয়া হয়৷ আবু হেনা মোস্তফা কামাল কষ্টে ও ক্ষোভে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে ইস্তফা দেন এবং ১৯৭৩ সালের ৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন ৷

গানের হেনা

'অনেক বৃষ্টি ঝরে/ তুমি এলে যেন এক মুঠো রোদ্দুর/ আমার দু'চোখ ভরে\\' এরকম অনেক চমত্‍কার গানের গীতিকার আবু হেনা মোস্তফা কামাল ৷ বাল্যকালেই গানের চর্চা শুরু করেছিলেন তিনি ৷ হতে চেয়েছিলেন গায়ক ৷ মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে নিজেকে বোঝার ক্ষমতা বাড়ে ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামালও পরে বুঝেছিলেন গাওয়া নয়, লেখার প্রবণতায় বাঁধা তাঁর জীবনের তার ৷ লেখালেখির শুরুতে তাই কবিতা ও গান রচনার প্রতি ছিল তাঁর মত্ততা ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই রচনা করেছেন অনেক কালজয়ী গান ৷ গীতিকার হিসেবে ওই বয়সেই পেয়েছেন ঈর্ষণীয় সাফল্য ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহপাঠী ও বন্ধু ছিলেন প্রয়াত শিল্পী ও সুরকার আনোয়ারউদ্দিন খান এবং কবি, সঙ্গীতশিল্পী ও ক্রীড়াবিদ আসাফউদদৌলা ৷ বন্ধু ছিলেন অকালপ্রয়াত সুরকার ও কন্ঠশিল্পী আবু বকর খান ৷ এদের অনুপ্রেরণা তাঁকে সঙ্গীতমগ্ন করেছে ৷ পরবর্তীকালে তাঁর অনেক গানে কন্ঠ ও সুর দিয়েছেন আনোয়ারউদ্দিন খান ৷ এছাড়া শিল্পী ফেরদৌসী রহমানের কন্ঠেও তাঁর অনেক গান দারুণ সফল হয়ে উঠেছে ৷ আবু হেনার গানের সুরকারদের মধ্যে আছেন আব্দুল আহাদ, কাদের জামেরী, আবেদ হোসেন খান, মশিহ-উল-আলম, আবু বকর খান, মীর কাসেম খান, মনসুর আহমেদ, শেখ মোহিতুল হক, খোন্দকার নূরুল আলম, শেখ সাদী খান, অজিত রায়, রাজা হোসেন খান, প্রনব ঘোষ, দেবু ভট্টাচার্য, অনুপ ভট্টাচার্য, সমর দাস, জালাল আহমেদ, সৈয়দ আনোয়ার মুফতী ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামালের লেখা অনেক গান তখনও যেমন রেডিও, টেলিভিশন ও গ্রামোফোনে শোনা যেত এখনও তেমন শোনা যায় ৷ ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো গান তিনি লেখেননি ৷
বেঁচে থাকতে গানের কোনো সংকলন করেননি আবু হেনা মোস্তফা কামাল ৷ মৃত্যুর পর ১৯৯৫ সালে তাঁর দুই শতাধিক গান নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী প্রকাশ করে 'আমি সাগরের নীল' গ্রন্থ ৷ তাঁর গানের সংখ্যা আরও অনেক বেশি ৷ দুই হাজারের মতো গান লিখেছেন তিনি ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামালের অনেক গানের বিষয় হয়েছে প্রেম ৷ প্রেমের বহুবিচিত্র অনুভূতিকে গীতিময়তার পাশাপাশি কাব্যের সংমিশ্রণে গানে গানে ফুটিয়ে তুলেছেন ৷ এছাড়া তিনি গান লিখেছেন নিসর্গ, প্রকৃতি, উত্‍সব, দেশাত্ববোধক ও ভাষা নিয়ে ৷ ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার বিন্যাসে পরিশীলিত সেসব গান ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামালের গান সম্পর্কে প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও সমালোচক আনিসুজ্জামানের মূল্যায়ন হচ্ছে- 'আবু হেনার কবিতার মতো গানেও প্রাধান্য পেয়েছে প্রেম ৷ এক মোহমুগ্ধ, স্বপ্নচারী, আবেগময় সত্ত্বা ক্রিয়াশীল ছিল তাঁর অধিকাংশ গীত রচনার ক্ষেত্রে ৷' তাঁর গানের বিষয় ও ভাষা সম্পর্কে আনিসুজ্জামান বলেন- 'বিষয় অনুযায়ী ভাষার বৈচিত্র্য তাঁর গানের একটি লক্ষণ ৷ আবু হেনার কবিতায় উপভাষার ব্যবহার নেই, কিন্তু গানে আছে- এটি লক্ষণীয় ৷ তাঁর অলঙ্কার ব্যবহারের নতুনত্বের চেয়ে বেশি আছে ঔচিত্য; কবিতায় যে সংযমের কথা বলেছি, এখানে তা কঠোর হয়ে বাণীতে প্রগাঢ়তা এনেছে ৷'

বাংলাদেশের আধুনিক বাংলা গানে যেসব গানকে আমরা চিরসবুজ বলতে পারি সেসব গানের মধ্যে আবু হেনা মোস্তফা কামালের অনেক গান আছে ৷ যেমন: ১) 'তোমার কাজল কেশ ছড়ালো বলে/ এই রাত এমন মধুর/ তোমার হাসির রঙ লাগল বলে/ দোলে ঐ মনের মুকুর\\' ২) 'সেই চম্পা নদীর তীরে/ দেখা হবে আবার যদি/ ফাল্গুন আসে গো ফিরে\\' ৩) 'হাতের কাঁকন ফেলেছি খুলে/ কাজল নেই চোখে/ তবু তোমার কাছে যাবো/ যা বলে বলুক লোকে\\' ৪) 'আমি সাগরের নীল/ নয়নে মেখেছি এই চৈতালি রাতে/ ফুলকঙ্কন পরেছি দখিন হাতে\\' ৫) 'ভ্রমরের পাখনা যতদূরে যাক না ফুলের দেশে/ তুমি তবু গান শুধু শোনাও এসে\\' ৬) 'নদীর মাঝি বলে: এসো নবীন/ মাঠের কবি বলে এসো নবীন/ দেখেছি দূরে ঐ সোনালি দিন\\' ৭) 'ওই যে আকাশ নীল হলো আজ/ সে শুধু তোমার প্রেমে\\' ৮) 'মহুয়ার মোহে গেল দিন যে/ তোমার কাছে আমার কত ঋণ যে/ সে কথা না হয় হলো নাই বলা/ ঝরা পাতার কান্না শুনে আজকে আমার পথ চলা\\' ৯) 'অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে সেদিন বর্ণমালা/ সেই থেকে শুরু দিন বদলের পালা\\' ১০) 'তুমি যে আমার কবিতা, আমার বাঁশির রাগিনী' ১১) 'পথে যেতে দেখি আমি যারে' ১২) 'যায় যদি যাক প্রাণ, তবু দেবো না দেবো না দেবো না গোলার ধান' ১৩) 'এই পৃথিবীর পান্থশালায় গাইতে গেলে গান' ৷

১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া আবু হেনা মোস্তফা কামালের গান দিয়ে ৷ গানের কথা ছিল, 'ওই যে আকাশ নীল হ'লো, সে শুধু তোমার প্রেমে' ৷ চলচ্চিত্রের জন্যও অনেক গান লিখেছেন আবু হেনা ৷ বাংলাদেশের যেসব চলচ্চিত্রে তাঁর গান ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'দর্পচূর্ণ', 'যোগবিয়োগ', 'অনির্বাণ', 'সমর্পণ', 'অসাধারণ' ও 'কলমীলতা' ৷ এর মধ্যে 'অসাধারণ' চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও তাঁর রচনা ৷ চলচ্চিত্রটির পরিচালক ছিলেন মুস্তফা আনোয়ার ৷

কবিতার হেনা

আবু হেনা মোস্তফা কামাল নিজের লেখা নিয়ে সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করেন বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে ৷ বাংলাদেশের সাহিত্যের তখন গড়ে উঠার বয়স ৷ বিশ শতকের তিরিশের দশকের কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যের আধুনিক রূপ ও রসের আস্বাদ নিয়ে নিজেদের নতুন করে গড়ে তোলার পাশাপাশি ঢাকা কেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যকে নতুন রূপে ও রসে জীবন্ত করে তুলেছেন যাঁরা আবু হেনা মোস্তফা কামাল তাঁদেরই একজন ৷ শুরুতে তিনি লিখতেন কবিতা ও গান ৷ গানের কথা আগেই বলা হয়েছে ৷ পঞ্চাশের দশকে শুরু করলেও প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় প্রায় দুই দশক পর ৷ ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'আপন যৌবন বৈরী' ৷ তখন তাঁর সমসাময়িক কবিদের অনেকেরই কাব্যসমগ্র, নির্বাচিত কাব্য ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে গেছে ৷ কবিদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে এত দীর্ঘ সময় নিতে সচরাচর দেখা যায় না ৷ বোধ করি আবু হেনা মোস্তফা কামালের যুক্তিবোধ ও ধৈর্য তাকে এমন সুতীব্র অপেক্ষমাণ বানিয়েছে ৷ উত্তরকালে তিনি যখন প্রবন্ধ ও সমালোচনা লিখেছেন তখন অবশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাঁর প্রবল যুক্তিবোধ ও ধৈর্যের বিষয়টি ৷ তাঁর প্রবন্ধ ও সমালোচনায় যুক্তিবোধ ও সহিষ্ণুতার প্রকাশ মেলে ৷ এমনকি তাঁর কবিতাগুলোতেও তার যুক্তিবোধ ও সংযমের ছাপ আছে ৷ কবিতায় তিনি দারুণ রোমান্টিক এবং কল্পনাবিলাসী হলেও রোমান্টিকতা ও কল্পনাবিলাসকে কবিতার জন্য কখন লাগাম টেনে ধরতে হয় তা ভালো করেই জানতেন ৷ 'আপন যৌবন বৈরী' কাব্যগ্রন্থের 'ইস্তাহার সাম্প্রতিক' কবিতা এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে ৷ রোমন্টিকতা ও কল্পনাবিলাসে পরিপূর্ণ অথচ সংযত এই কবিতাটি মাত্র পাঁচ লাইনের ৷ 'স্বৈরিণী তোমাকে ভালোবাসি ব\'লে/ এ-পাড়ার স্বাস্থ্যরক্ষী মহোদয়গণ/ সম্প্রতি আমার নামে নিন্দার পোস্টার/ এঁটেছেন দেয়ালে দেয়ালে ৷ আর তাঁদের শ্লোগান:/ এটা ভদ্রপাড়া, এখানে নিষিদ্ধ সব কোকিলের গান\\'।
আবু হেনা মোস্তফা কামালের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'যেহেতু জন্মান্ধ' প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের দশ বছর পর অর্থাৎ‍ ১৯৮৪ সালে ৷ এর চার বছর পর (মৃত্যুর এক বছর আগে) ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় এবং সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ 'আক্রান্ত গজল' ৷ তিনটি গ্রন্থে মোট কবিতা আছে শতাধিক ৷ এর বাইরে তাঁর আরও অনেক কবিতা অপ্রকাশিত থেকে গেছে ৷ গান দিয়ে যেমন শ্রোতাকে মুগ্ধ করেছিলেন তেমনি কবিতা দিয়েও পাঠকের চিত্ত জয় করেছিলেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল ৷ সমালোচকরাও তাঁর কবিতার প্রশংসা করেছেন ৷

কবিতায় আবু হেনা মোস্তফা কামালের প্রধান অবলম্বন প্রেম ও নারী ৷ কবিতার ছন্দের ক্ষেত্রে আবু হেনা মোস্তফা কামাল গুরুত্ব দিয়েছেন কবিতাটির মেজাজকে ৷ যে কবিতার মেজাজ যে রকম ছন্দও হয়েছে সেরকম ৷ গদ্যছন্দে লিখেছেন অনেক ৷ স্বরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্তে লেখাও কম নয় ৷ তবে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের স্বাধীনতাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন পুরোপুরি ৷ তাঁর কবিতা পড়ে মনে হয়েছে, অক্ষরবৃত্তই ছিল তাঁর সহজাত ছন্দ ৷ তাঁর কবিতায় শব্দ ব্যবহারে একটা মার্জিত ব্যাপার আছে ৷ শব্দ প্রয়োগ, নতুন শব্দ ও বাক্য তৈরি, ইংরেজি শব্দের ব্যবহার, বিদ্রূপ বা উপহাস, চিত্রকল্প ও অন্যান্য অলঙ্কারের ব্যবহার- এসবের কোনো ক্ষেত্রেই তিনি এমন কিছু করেননি যা তাঁর কবিতাকেই ক্ষুণ্ন করতে পারে ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতা সম্পর্কে সাহিত্য সমালোচক আনিসুজ্জামানের মূল্যায়ন: 'কবিতায় কখনো তিনি সীমা লঙ্ঘন করেন না ৷ এই সংযম তাঁর স্বভাবজাত নয়, অর্জিত, এবং সংযমের ফলে তাঁর অনেক কবিতা বলা- না বলার আলোছায়ায় ঘিরে থাকে ৷ স্তবক, চরণ, শব্দ সরিয়ে সরিয়ে পাঠককে তার অন্দরমহলে প্রবেশ করতে হয় ৷ প্রায় চল্লিশ বছরের সাধনায় আবু হেনা বিস্তর ফসল ফলাননি বটে, কিন্তু যা ফলিয়েছেন তার অধিকাংশই স্বর্ণশস্য ৷ আরো আশ্চর্য এই যে, নিজেকে নতুন করে নিতে তাঁকে বেশি কালক্ষয় করতে হয়নি, অধিক ভাবতে হয়নি ৷'

প্রবন্ধের হেনা

আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন একজন উত্‍কৃষ্ট মানের প্রাবন্ধিক ৷ কবিতা দিয়ে সাহিত্যে তাঁর যাত্রা শুরু হলেও প্রবন্ধ ও সমালোচনায় ছিলেন সবচেয়ে সফল ৷ বয়স বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে সাহিত্যের মননশীল ধারায় তাঁর বিচরণ ৷ তাঁর মননশীল রচনাগুলোতে বহুবিধ প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে ৷ গল্প, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, সময়, সমাজ, সমকাল- এরকম বিষয়কে কেন্দ্র করে তাঁর মননশীল রচনাগুলো ৷ প্রাবন্ধিক আবু হেনার ঝোঁকের একটা জায়গা ছিল উনিশ শতক। আবু হেনা মোস্তফা কামালের জীবদ্দশায় প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ দুটি ৷ প্রথমটি সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন 'শিল্পীর রূপান্তর' ৷ এই গ্রন্থের আটটি প্রবন্ধের মধ্যে চারটিরই বিষয় উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ ও সাহিত্য ৷ এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে ৷ অন্যটি সাহিত্য সমালোচনা বিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন 'কথা ও কবিতা' ৷ এটির প্রকাশকাল ১৯৮১ ৷ এই গ্রন্থের মোট ১১টি প্রবন্ধের মধ্যে তিনটিরই পটভূমি উনিশ শতক ৷ এছাড়া ১৯৭৭ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত তাঁর ইংরেজি অভিসন্দর্ভ 'দ্য বেঙ্গলি প্রেস অ্যান্ড লিটারারি রাইটিং' এর বিষয় উনিশ শতকের গোড়ার দিকের সাময়িকপত্র ও সৃষ্টিশীল সাহিত্য ৷
প্রাবন্ধিক হিসেবে আবু হেনার সবচেয়ে বেশি ঝোঁক ছিল বিশ্লেষণে ৷ প্রবন্ধে আলোচ্য বিষয়ে নতুন কোনো তথ্য উদ্ঘাটনের চেয়ে বিশ্লেষণের ওপর বেশি জোর দিয়েছেন তিনি ৷ মূলত বিশ্লেষণের পথ ধরে তাঁর প্রবন্ধে উদ্ভাবনের ঘটনা ঘটেছে ৷

আবু হেনার প্রবন্ধ চর্চার একটা ধারাবাহিকতা আছে ৷ প্রবন্ধ লেখা তিনি শুরু করেছিলেন আধুনিক বাংলাসাহিত্যের গোড়ার সময়টুকু ধরে ৷ উনিশ শতকের শুরুর সময়টিকে আধুনিক বাংলাসাহিত্যের ভিত্তি ধরে নিয়ে সেটিকে গভীরভাবে বুঝতে চেয়েছেন তিনি ৷ এরপর ক্রমে এগিয়ে এসেছেন বিশ শতকের দিকে ৷ বাংলাসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্রতুল্য ব্যক্তি ও সমুজ্জ্বল গ্রন্থগুলো পাঠের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর সময়ের রচয়িতাদের দিকে অভিনিবেশ করেছেন ৷ একই সঙ্গে সৃজনশীল ও মননশীল হওয়ার কারণে তাঁর এই ধারাবাহিক বোঝাপড়ার দরকার ছিল ৷

সমাজ ও সমকাল নিয়ে আবু হেনা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অনেক কলাম লিখেছেন ৷ 'দৈনিক বাংলা' পত্রিকায় তিনি কলাম লিখতেন 'অমত্‍সর' ও 'দ্বিতীয় চিন্তা' নামে ৷ সাপ্তাহিক পত্রিকা 'বিচিত্রা'য় লিখতেন 'অবান্তর কথকতা' ৷ 'চিত্রালী উপহার' পত্রিকায় লিখতেন 'অতিথির কলাম' ৷ বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত 'ধান শালিকের দেশ' পত্রিকায় 'ইছামতীর সোনালী-রূপালী' শিরোনামে নিজের ছেলেবেলার নানা ঘটনা লিখেছেন ৷ আলবেয়ার ক্যামুর 'ক্যালিগুলা' নাটকটি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন তিনি ৷ আবু হেনা মোস্তফা কামালের বিভিন্ন ধরনের গদ্য নিয়ে তাঁর মৃত্যুর পর ২০০০ সালে 'কথাসমগ্র' নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে সময় প্রকাশন ৷

নিজের লেখা সংরক্ষণ করা হয়ে উঠত না আবু হেনার ৷ সংরক্ষণের চেয়ে লিখে যাওয়ার ব্যাপারেই তিনি বরাবর বেশি নিবেদিত ছিলেন ৷ 'শিল্পীর রূপান্তর' ও 'কথা ও কবিতা'- এই দুটি প্রবন্ধগ্রন্থের বাইরে আবু হেনার আরও অনেক প্রবন্ধ অগ্রন্থিত রয়েছে ৷

পুরস্কার ও সম্মান

বাংলা কবিতা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য আবু হেনা মোস্তফা কামাল বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন ৷ ১৯৭৫ সালে 'আপন যৌবন বৈরী' কাব্যের জন্য ফরিদপুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি উন্নয়ন সংস্থার 'আলাওল পুরস্কার', ১৯৮৬ সালে কবিতার জন্য যশোর সাহিত্য গোষ্ঠীর 'সুহৃদ সাহিত্যগোষ্ঠী স্বর্ণপদক', ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের 'একুশে পদক', ১৯৮৯ সালে তিনি 'সচেতনা সাহিত্য পুরস্কার' ও 'আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ স্বর্ণপদক' লাভ করেন তিনি ৷ এছাড়াও পেয়েছেন 'সাদত আলী আকন্দ স্মৃতি পুরস্কার' ৷

মৃত্যু

বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক থাকাকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ১৯৮৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল ৩ টা ৪৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল ৷ মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর ৷ ঢাকার আজিমপুর নতুন কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তিনি ৷

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

এই লেখাটির জন্য বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত আনিসুজ্জামান ও বিশ্বজিত্‍ ঘোষ সম্পাদিত গ্রন্থ 'আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচনাবলী' প্রথম খণ্ডের বিশেষ সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে ৷ আনিসুজ্জামান ও আব্দুল মান্নান সৈয়দের উদ্ধৃতিগুলোও ওই গ্রন্থ থেকেই নেওয়া ৷ বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী সুজিত মোস্তফার উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে সময় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত আবু হেনা মোস্তফা কামালের রচনা সংকলন 'কথাসমগ্র' গ্রন্থের ভূমিকা থেকে ৷ তথ্য সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে বাংলা একাডেমী প্রকাশিত শামসুজ্জামান খান, সেলিনা হোসেন ও জাকিউল হক সম্পাদিত "একুশের স্মারকগ্রন্থ '৯০" থেকে ৷ এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে তথ্য ও অন্যান্য সহযোগিতা দিয়েছেন আবু হেনা মোস্তফা কামালের কন্যা কাবেরী মোস্তফা ও পুত্র সুজিত মোস্তফা ৷

No comments: