| Home | Menu | Poems | Poets | Reading | Theme | Biography | Articles | Photo | Dictionary | Chat | Video | Shop | Extra | Jokes | Games | Science | Bio | বাংলা

রিজিয়া রহমান Rijia Rahman Biography 1939-



যুদ্ধ৷ সারা পৃথিবী জুড়ে বেজে উঠেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা৷ ব্রিটিশদের এক বিশাল উপনিবেশ ভারত উপমহাদেশের কলকাতাতেও পুরোদমে ছড়িয়ে পড়েছে সে যুদ্ধ৷ সাইরেন, বোমা, ধোঁয়া, শব্দ, এ আর পি, দ্রুত গতির মিলিটারি লরি, উদ্বান্ত মানুষ- সব মিলিয়ে এক অস্থির কলকাতা৷ সাইরেন বাজলেই পথ ঘাটের মানুষ দ্রুত ছুটে পালাতে শুরু করে৷ লুকিয়ে পড়ে রাস্তার ধারে ধারে 'সেন্টার ওয়ালের' আড়ালে নয়ত মাঠের ট্রেন্চে৷ ঘরের দরজা জানালা বন্ধ হয়ে যায়৷ কাচের জিনিসপত্র নামিয়ে দেয়া হয় নিচে, মেঝেতে৷ কেউ কেউ কানে তুলো গুঁজে বসে পড়ে ঘরের দেয়াল ঘেঁসে, ঘরের কোনগুলোতে, উত্‍কর্ণ হয়ে শোনে জাপানি প্লেনের গুট গুট শব্দ৷ বোমা আর অ্যান্টি এয়ারক্রাফটের শব্দ শহর কাঁপায়৷ হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সগুলো বাঁশি বাজিয়ে একটার পর একটা ফিরে আসে৷ হাসপাতালের ডাক্তাররা তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ সাইরেন বাজলেই সেখানে ইমারজেন্সি ডিউটি শুরু হয় তাঁদের৷ কলকাতার পুলিশ হাসপাতালে এমনি এক ইমারজেন্সিতে ব্যস্ত সময় পার করেন ডাক্তার আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক৷

If you cannot view the fonts properly please download and Install this file.

ডাক্তার আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিকের এক মেয়ে জোনাকী৷ যেন আসলেই একটা জোনাকী৷ যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স চার, পাঁচ বছর৷ কেবল বোমারু বিমান উড়ে যাওয়ার সময়, ভয় ধরানো শব্দে, সাইরেন বাজলে একটু ভয় পেয়ে চুপ করে নিভে যায় জোনাকী আর এর পর পরই শুরু হয় একমনে জ্বলে উঠা নিভে যাওয়ার খেলা৷ 'অল ক্লিয়ারের' সাইরেন বেজে উঠলেই ঘরের দরজা খুলে বের হয়ে মাঠে যায়৷ খেলার সাথিদের সঙ্গে কালো কাঁকর বিছানো রাস্তায়, মাঠে, বাড়ির সামনের সিঁড়িতে বোমার স্প্লিন্টার কুড়ায়৷ মাঠের মাঝে জিগজাগ করে কাটা ট্রেন্চে নেমে দুষ্টুমি করে, ফড়িং ধরে খেলে৷ আর খেলা শেষে স্প্লিন্টার নামের মরণাস্ত্রের বাতিল টুকরাগুলো সিঁড়িতে সাজায়, ফুল তৈরি করার চেষ্টা করে৷ এইভাবে সেই সময়ে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম কালে জোনাকী নামের ছোট্ট খুকিটি যুদ্ধের হাত ধরাধরি করেই বেড়ে উঠেছে৷

বাবার পছন্দের জোনাকী নামের এই মেয়েটি ছিল একটু অন্য রকম এক শিশু৷ বারো মাস অসুখ বিসুখ লেগেই আছে, দুর্বল শরীর৷ খেলাধুলা, ছোটাছুটি করার সামর্থ্য কম৷ গলার শব্দ কমজোর- চেঁচামেচি, হৈ হুল্লোড় করার শক্তিও কম৷ আর এই দুর্বল শরীরের কারণে কখনও কখনও মাঠে যেয়ে খেলা করলেও বেশির ভাগ সময় ঘরের কোন কোনায় বসে একা একা কথা বলে, ঘরের বারান্দায় একা আপনমনে খেলা করে৷ কথা বলে কাক আর চড়ুইয়ের সাথে৷ এই আপনমনের খেলাই তাঁকে করে তুলেছিল ভাবুক আর কল্পনাপ্রিয়৷ অনায়াসে তৈরি করে দেয় কাক, চড়ুইয়ের বাক- ক্ষমতা, বাড়ির সামনের রাস্তাটির শেষপ্রান্তে ঝাপড়ানো বিশাল বট গাছটিকে ভেবে বসে দৈত্য, দেয়ালের ওপরে লাফিয়ে ওঠা সাদা বেড়ালটিকে ভেবে নেয় পঙ্খিরাজ ঘোড়া৷ এই কল্পনা বিলাস, এই ভাব-ক্ষমতা আর যুদ্ধের মতো চরম দুর্বিপাকেও শিল্প সৃষ্টির তাড়নাই একদিন ছোট্ট জোনাকীকে এক বড় শিল্পী, এক বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত করে তোলে৷ এই ছোট্ট জোনাকীই আজকের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান৷

রিজিয়া রহমানের আদি পৈত্রিক নিবাস দক্ষিন কলকাতার কাশিপুর থানার নওবাদ গ্রামে৷ কিন্তু জন্মেছেন কলকাতার ভবানীপুরে৷ তাঁর পারিবারিক ইতিহাস ঐতিহ্য খুঁজলে দেখা যায় বংশ পরম্পরায় এই পরিবারটি একটার পর একটা অভিবাসন তৈরি করে চলেছে৷ মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তান থেকে এসে হিন্দুস্তানে এই পরিবারের অভিবাসন ঘটিয়ে ছিলেন হায়াত মাহমুদ খান নামের তুর্কীভাষী এক ধার্মিক পুরুষ৷ মধ্যযুগের প্রাচুর্যের নগরী সমরখন্দে ছিল তাঁর আবাস৷ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সুফি দরবেশদের সহযাত্রী হয়ে দুর্গম দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে তিনি এসেছিলেন বঙ্গদেশে৷ আবাস গেড়েছিলেন কলকাতার চব্বিশ পরগনার নওবাদে৷ সেই উজবেক হায়াত মাহমুদ খানের অষ্টম পুরুষ মুন্সী আব্দুল খালেক রিজিয়া রহমানের দাদা৷ মুন্সী আব্দুল খালেক কলকাতার লন্ডন মিশনারি স্কুলে লেখাপড়া করেছেন৷ চাকরী করতেন কলকাতায়৷ সেই সুবাদে এখানে আরেক অভিবাসনের গোড়া পত্তন ঘটে৷ মুন্সী আব্দুল খালেকের একমাত্র ছেলে আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক ডাক্তারি পেশার সুবাদে আসেন বাংলাদেশের চট্টগ্রামে৷ এখানে পরিচয় হয় রিজিয়া রহমানের খালুর সঙ্গে৷ তিনি তখন চট্টগ্রাম জেলখানার ডেপুটি জেলার৷ এবং তাঁর মধ্যস্থতাতেই মরিয়াম বেগম ও আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিকের পরিণয় ঘটে৷ ৪৭'র দেশ বিভাগের পর এই পরিবার বাংলাদেশে থিতু হয়৷ পরবর্তীতে এই পরিবারের অনেকেই অভিবাসন গড়ে তোলে আমেরিকায়৷ এই হচ্ছে লেখক রিজিয়া রহমান ও তাঁর পরিবারের অভিবাসনের ইতিহাস৷

রিজিয়া রহমান একটি সাংস্কৃতিক পারিবারিক আবহে বেড়ে উঠেছিলেন৷ দাদার ছিল পড়ালেখার অভ্যেস৷ দহলিজ ঘরে তাঁর নিজস্ব একটি পড়ার ঘর ছিল৷ সেই ঘরে তাক ভর্তি ছিল ইংরেজি আর ফার্সি বই৷ শেষ বয়সে তিনি সারাদিন পড়তেন আর লিখতেন৷ ধারণা করা হয় তিনি সম্ভবত ইংরেজিতে কোন বই লিখছিলেন৷ যদিও সে বই তিনি শেষ করে যেতে পারেননি আর সেটি প্রকাশও হয় নি৷ দেশ বিভাগের পর বাড়ি বদলের ঝামেলায় শেষ পর্যন্ত পাণ্ডুলিপিটিও হারিয়ে যায়৷ বাবার ছিল সংগীতের প্রতি অসাধারণ টান৷ এস্রাজ বাজানোর শখ ছিল তাঁর, বাঁশিও বাজাতেন৷ ভালোবাসতেন কবিতা ও সংগীত৷ গান শোনার শখ ছিল তাঁর মায়েরও৷ কানন বালা, সায়গল, জগন্ময় মিত্রের গান পছন্দ করতেন তাঁর মা৷ নিজে গিয়ে কিনে আনতেন হিন্দি আর বাংলা জনপ্রিয় গানের রেকর্ড৷ বাবা পছন্দ করতেন ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও ইংরেজি উচ্চাঙ্গ বাজনা৷ কমলা ঝরিয়ার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত আর ওয়ালজ, ফঙ্ট্রট বাজনা ছিল তাঁর প্রিয়৷ আর খুব ছোট বেলা থেকেই রিজিয়া রহমানের গানের প্রতি অনুরাগ ছিল৷ সেই ছোটবেলায় কিছু না বুঝেই গুনগনিয়ে গাইতেন- " ছোটি সি মন মেরে/ ছোটি সি দুনিয়ারে,/ ছোটি ছোটি দিন হো/ আওর ছোটি ছোটি রাতে... ৷

পড়ালেখার প্রতি রিজিয়া রহমানের ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই৷ কলকাতার ভবানীপুরে তাঁদের পাশের বাড়িতে থাকতেন তাঁর বাবার সহকর্মী ডাক্তার মাহমুদ৷ তাঁর স্ত্রী বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ৷ কলকাতার লেডি ব্রাবোন কলেজের অধ্যাপিকা তিনি৷ প্রতিদিন সকালে সাদা ঘোড়ার ফিটন গাড়িতে চড়ে, অনেকগুলো বই হাতে নিয়ে তিনি পড়াতে যান৷ শামসুন্নাহারকে তাঁর ভীষণ ভাল লাগত৷ কারণ তাঁর ঘর ভর্তি বই ছিল৷ তাঁদের বাড়িতে মাঝে মাঝে খেলতে যেতেন রিজিয়া রহমান৷ অন্যরা যখন টানা বারান্দায় ছুটোছুটি করতো তিনি তখন বইয়ের তাকের সামনে উত্‍সুক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকতেন৷ বইয়ের না জানা জগতটিকে স্পর্শ করতে চাইতেন মনে মনে৷ শামসুন্নাহার মাহমুদ এগুলো লক্ষ্য করতেন৷ মাঝে মাঝে এসে বই নামিয়ে দিতেন৷ বলতেন, 'যাও দেখো নিয়ে'৷ ভারি বড়োসড়ো বই দুহাতে জাপ্টে ধরে চলে আসতেন বারান্দায়৷ দেয়ালে হেলান দিয়ে লম্বা করে ছড়িয়ে দেয়া দুপায়ের ওপর বইটি রেখে পৃষ্টা উল্টে যেতেন, কিছু পড়তে পারতেন না৷ একটি সুন্দর রূপকথার বই পড়তে না পেরে একবার তিনি কেঁদে উঠেছিলেন৷ শামসুন্নাহার মাহমুদের বড় ছেলে মামুন তাঁর কান্নার কারণ শুনে হেসে বলেছিলেন, চলো তোমাকে আমি পড়ে শুনাচ্ছি৷ পড়ার জগতে রিজিয়া রহমানের প্রবেশ ঘটে এভাবেই৷

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়া শুরু করেছিলেন বাবার কর্মস্থল ফরিদপুরে৷ তারপর বাবার চাকরি সূত্রে ছুটোছুটি৷ ফলে নিরবিচ্ছিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন তাঁর কোনকালেই ঘটেনি৷ নানার বাড়ি ঢাকা জেলার শাইনপুকুরে৷ ১৯৫২ সালে বাবার মৃতু্যর পর তাঁর নানার বাড়ি ঢাকা আর ফরিদপুর ছুটোছুটি করতে করতে কখন যেন সামনে এসে দাঁড়ায় মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়৷ মামার চাকরিস্থল চাঁদপুরের এক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তড়িঘড়ি করে ভর্তি হন নবম শ্রেণীতে৷ সেখানেও ঘটে এক বিপত্তি৷ তখনকার রক্ষণশীল সমাজ৷ মেয়েদের বাইরে বেরুনোর হাজার রকম প্রতিবন্ধকতা৷ ফলে মামার পরিবার থেকে দাবী উঠল স্কুলে যেতে হলে বোরখা পরে যেতে হবে৷ আজন্ম উদার সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠা রিজিয়া রহমান তো অবাক! তাঁর মা-ই কোনদিন বোরখা পড়েননি আর তিনি কিভাবে পড়বেন? তবু একবার বোরখা পড়ে বের হলেন স্কুলে যেতে৷ মাঝ রাস্তায় বোরখায় প্যাঁচ লাগিয়ে আছাড় খেয়ে পড়লেন জনসম্মুখে৷ এরপর তিনি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে এক বছর আগেই প্রাইভেটে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলেন৷ এরপর তাঁর বিয়ে হয়৷ স্বামী খনিজ ভূতত্ববিদ মোঃ মীজানুর রহমান৷ স্বামীর চাকরি পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে৷ সেই সুবাদে সেখানে কোয়েটা গভর্মেন্ট কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে দুই বছর পড়াশুনা করার পর পরীক্ষার সময় মাইগ্রেশান সার্টিফিকেট নিয়ে জটিলতা বাধলো, পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দিল না৷ ফলে আবার দেশে ফিরে ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন৷ একই কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে ডিগ্রি পাশ করেন৷ পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাষ্টার্স পাশ করেন৷

লেখালেখিতে রিজিয়া রহমানের আগমন খুব অল্প বয়সেই৷ তিনি সাহিত্য চর্চা শুরু করেছিলেন কবিতার মাধ্যমে৷ পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় সেই কবিতা অথবা ছড়া ছাপা হয়েছিলো সত্যযুগ পত্রিকায় ছোটদের বিভাগে৷ তাঁর প্রথম গল্পও ছাপা হয়েছিল এই পত্রিকাতেই৷ এটিও ছোটদের বিভাগে৷ পরবর্তীতে দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় তাঁর কবিতা ছাপা হয়৷ বড়দের জন্য তাঁর লেখা প্রথম প্রকাশিত হয় ইডেন কলেজ ম্যাগাজিনে৷ এরপর ললনা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় তাঁর ঘর ভাঙা ঘর উপন্যাস, যেটি বাংলা কথাসাহিত্যে সংযোজিত করে এক নতুন অধ্যায়ের৷

স্বাধীনতা-উত্তরকালে যে সব নতুন ঔপন্যাসিকের আগমন ঘটেছে রিজিয়া রহমান তাঁদের অন্যতম৷ বিষয় বৈচিত্র এবং শৈল্পিক উত্‍কর্ষে তাঁর উপন্যাসসমূহ বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে অর্জন করেছে স্বতন্ত্র মাত্রা৷ তাঁর ঘর ভাঙা ঘর বস্তিজীবনের ক্লেদাক্ত যন্ত্রণার শব্দরূপ; আর রক্তের অক্ষর হচ্ছে নিষিদ্ধ পল্লীর যন্ত্রণাদগ্ধ প্রাত্যহিকতার ভাষাচিত্র৷ চট্টগ্রামের হার্মাদ জলদস্যুদের অত্যাচার এবং পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের দৈনন্দিনতা নিয়ে গড়ে উঠেছে রিজিয়া রহমানের উত্তর পুরুষ৷ বাংলাদেশে পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচার এবং প্রতিষ্ঠাচিত্রণ সূত্রে এ উপন্যাসে ফুটে উঠেছে আরাকান-রাজ-সন্দ- সুধর্মার অত্যাচারের কাহিনী, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্বের কথা, পতর্ুগিজদের গোয়া, হুগলি, চট্টগ্রাম দখলের ইতিহাস৷ এ উপন্যাসের ব্যতিক্রমী চরিত্র বনি, যে পর্তুগিজ নাগরিক হয়েও, বাংলাদেশকে দ্বিতীয় স্বদেশ হিসেবে গ্রহণ করেছে, ভালোবেসেছে এদেশের শ্যামল প্রকৃতি আর শ্যামল মানুষকে এবং ভিতরে ভিতরে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে পর্তুগিজ অত্যাচারের বিরুদ্ধে৷

বং থেকে বাংলা উপন্যাসে রিজিয়া রহমান বাঙালির ইতিহাস সন্ধানী এবং সমকালস্পর্শী৷ শ্রম অধ্যবসায় ইতিহাসজ্ঞান এবং শিল্প চেতনার অন্তরমিলনে 'বং থেকে বাংলা' উপন্যাসটি বাংলা কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বল শিল্পকর্ম৷ এখানে সঙ্গত কারণেই ইতিহাসকে তিনি স্বচ্ছন্দপ্রয়াসে পরিণত করেছেন শিল্পে এবং শিল্পের দাবীতে, ইতিহাসের ধূসরতায় মিশেছে কল্পনার সৌরভ৷ রিজিয়া রহমান এ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন শতাব্দী পরম্পরায় প্রবাহমান এই ব-দ্বীপের অবহেলিত উপেক্ষিত অধিকারহীন মানুষের যাপিত জীবন; আর সে সূত্রেই এ উপন্যাসে উঠে এসেছে বাঙালি জাতি গঠনের অতীত ইতিহাস৷ এ প্রসঙ্গে লেখকের ভাষ্য : "বাংলাদেশের জাতিগঠন ও ভাষার বিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে 'বং থেকে বাংলা' উপন্যাসের সৃষ্টি৷... আড়াই হাজার বছর আগে বং গোত্র থেকে শুরু করে উনিশশ একাত্তুরের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়কাল পর্যন্ত দীর্ঘ পরিব্যাপ্তির মধ্যে এ-উপন্যাসের কাহিনী বিন্যাস করা হয়েছে৷...বাংলার সিংহাসন চিরকাল বিদেশী ক্ষমতালিপ্সু এবং সম্পদলোভীদের দ্বারা শাসিত হয়েছে৷ বাংলার সাধারণ মানুষ চিরকালই অবহেলিত উপেক্ষিত এবং উত্‍পীড়িত৷ জাতি হিসেবে সামাজিক অর্থনৈতিক গণতান্ত্রিক মর্যাদা তারা কোনদিন পায়নি৷ 'বং থেকে বাংলা' যেমন একদিকে ইতিহাসের সঙ্গে সেই কথাটিই প্রকাশ করেছে, তেমনি কি করে সুদীর্ঘ দিনে একটি জাতি স্বাধীনতার মর্যাদায় এসে দাঁড়িয়েছে তারই চিত্রণের চেষ্টা করেছে৷" (সূত্র: রিজিয়া রহমান: বং থেকে বাংলা, ১৯৭৮, ঢাকা, ভূমিকা, পৃষ্ঠা ২২)

ভারত উপমহাদেশের প্রান্তসীমায় অবস্থিত বেলুচিস্তানের স্বাধীনচেতা মানুষ, যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী সামাজিক অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার, তাদের দেশ প্রেম আর স্বজাত্যবোধের গৌরব আর সাহসের অনুপম শিল্পরূপ রিজিয়া রহমানের উপন্যাস 'শিলায় শিলায় আগুন'৷ ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিলুচিস্তানের বিদ্রোহ ও কালাতের যুদ্ধের পটভূমিতে রচিত হয়েছে এ উপন্যাস৷ তবে লেখকের সচেতন শিল্পদৃষ্টির স্পর্শে, এক বেলুচিস্তানের কাহিনীর আধারে, এখানে অভিব্যাঞ্জিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী শোষিত মানুষের সংগ্রাম সাহস আর স্বপ্নের কথা৷

উত্তর বাংলার সাঁওতাল জীবন নিয়ে লেখা রিজিয়া রহমানের 'একাল চিরকাল' এক মহাকাব্যিক উপন্যাস৷ এ উপন্যাস ধারণ করেছে সাঁওতাল জনপদের সুদীর্ঘকাল, এবং এখানে আছে সাঁওতালদের আনন্দ, বেদনা, প্রত্যাশা, প্রাপ্তি, ধর্মবিশ্বাস, কুসংস্কার, শোষণ, বঞ্চনা এবং ঈর্ষা আর স্বার্থপরতার ছবি৷ এই আরণ্যক আদি মানুষের জীবন, সভ্যতার স্পর্শে এক সময় বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে: "প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারের নীলাভ কুয়াশা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে মানুষ হড়৷ হড়রাই সেই নীলাভ অন্ধকারের পবিত্রতা দু'হাতের মুঠোয় ভরে ছড়িয়ে দেয় চারিদিকে৷ আর অনেক দূর থেকে শংখিনী সাপের আঁকা বাঁকা দেহভঙ্গীর কুটিলতা নিয়ে পথ খুঁজে খুঁজে এগিয়ে আসে সভ্যতা৷"(একাল চিরকাল, ১৯৮৪ ঢাকা, পৃষ্ঠা-৯)

আদিম জনপদের এই বিপর্যয়েরই শিল্পরূপ 'একাল চিরকাল'৷ ভাষার ক্ল্যাসিক সংহতি, গভীর অন্তর্দৃষ্টি, ইতিহাসনিষ্ঠা, সমাজ সচেতনতা এবং শৈল্পিক সতর্কতা- সবকিছুর অন্তর্মিলনে রিজিয়া রহমানের এ উপন্যাস বাংলা কথাসাহিত্যের এক বিশিষ্ট সম্পদ৷ (সূত্র: বাংলাদেশের সাহিত্য, বিশ্বজিত্‍ ঘোষ)

লেখালেখির স্বীকৃতি হিসাবে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন রিজিয়া রহমান৷ জীবনের প্রথম পুরস্কার লাভ করেন ১৯৭৫ সালে৷ অনন্যা সাহিত্য পুরস্কারটি ছিল তাঁর জীবনের প্রথম পুরস্কার৷ এরপর ১৯৭৮ সালে লাভ করেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে লাভ করেন যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার৷ হুমায়ুন কাদির স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৮৪ সালে৷ আসফ-উদ-দৌলা রেজা স্মৃতি পুরস্কার গ্রহণ করেন ১৯৮৪ সালে৷ এরপর ১৯৮৫ সালে লাভ করেন বাংলাদেশ লেখক সংঘ সাহিত্য পদক এবং ১৯৯০ সালে তাঁকে দেওয়া হয় কমর মুশতারি সাহিত্য পদক ৷

রিজিয়া রহমান কর্মজীবনে একাধিক কর্ম ও একাধিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত থাকলেও শেষ পর্যন্ত লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন৷ তিনি তাঁর সুদীর্ঘ কর্মজীবনের মাঝে সাহিত্য পত্রিকা 'ত্রিভূজ' এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ এছাড়া জাতীয় জাদুঘরের পরিচালনা বোর্ডের ট্রাস্টি ও জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের কার্য পরিচালক হিসেবে কাজ করেন৷ তিন বছর দায়িত্ব পালন করেন বাংলা একাডেমীর কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে৷ দীর্ঘ কয়েক বছর তিনি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহকারী অধ্যক্ষ হিসাবে অধিষ্ঠিত ছিলেন৷ অবশেষে বিভিন্ন ও বিচিত্র পেশা থেকে সরে এসে লেখালেখিতেই একান্তভাবে মনোনিবেশ করেছেন রিজিয়া রহমান৷

ষাটের দশকের এই নামী কথাসাহিত্যিক জন্মেছিলেন কলকাতার ভবানীপুরে৷ বাবা ডাক্তার আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক৷ মা গৃহিনী মরিয়াম বেগম৷ তাঁরা ছিলেন চার ভাই এবং সাত বোন৷ সবার বড় ভাই ছিলেন ডাক্তার৷ আমেরিকার জন হপকিন্স মেডিক্যাল কলেজ থেকে ট্রপিক্যাল ডিজিজে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন৷ মেজভাই ব্যবসা করতেন, সেজভাইও ডাক্তার, বসবাস করছেন ইংল্যান্ডে আর ছোটভাই ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার৷ বোনেরাও অভিবাসন গড়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে৷ স্বামী মোঃ মীজানুর রহমান৷ তিনি খনিজ ভূ-তত্ববিদ৷ তাঁদের এক সন্তান আব্দুর রহমান৷ বিদেশে উচ্চতর পড়াশোনা করে বর্তমানে ঢাকায় একটি কনসালটেন্সি ফার্মের কর্ণধার৷ রিজিয়া রহমান বর্তমানে বাস করছেন ঢাকার উত্তরায়৷

লেখালেখির বাইরে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন রিজিয়া রহমান৷ দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাঁর স্বজন, পরিজন৷ সেই সুবাদে ঘুরে বেরিয়েছেন লন্ডন, ফ্রান্স, কানাডা, আমেরিকা৷ সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন সিঙ্গাপুর, ভারতের দিল্লি ও উত্তর আমেরিকা৷

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

জন্ম : ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৩৯, ভবানীপুর, কলকাতা৷
বাবা : আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক
মা : মরিয়াম বেগম
ম্বামী: মোঃ মীজানুর রহমান
সন্তান : এক ছেলে৷ আব্দুর রহমান৷
শিক্ষা: এস এস সি; (প্রাইভেট), এইচ এস সি; ইডেন কলেজ ঢাকা,
স্নাতক;, ইডেন কলেজ, ঢাকা, স্নাতকোত্তর; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷

প্রকাশিত গ্রন্থ :
গল্প : অগ্নিস্বাক্ষরা (১৯৬৭), নির্বাচিত গল্প (১৯৭৮)
উপন্যাস : ঘর ভাঙা ঘর (১৯৭৪), উত্তর পুরুষ (১৯৭৭), রক্তের অক্ষর (১৯৭৮), বং থেকে বাংলা (১৯৭৮), অরণ্যের কাছে (১৯৭৯), শিলায় শিলায় আগুন (১৯৮০), অলিখিত উপাখ্যান (১৯৮০), ধবল জোত্‍স্না (১৯৮১), সূর্য সবুজ রক্ত (১৯৮১), একাল চিরকাল (১৯৮৪), হে মানব মানবী (১৯৮৯), হারুন ফেরেনি (১৯৯৪)৷
অনুবাদ : সোনালী গরাদ (১৯৯৫)৷

পুরস্কার : অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৫), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৮), যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৪), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), আসফ-উদ-দৌলা রেজা স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৪), বাংলাদেশ লেখক সংঘ সাহিত্য পদক (১৯৮৫), কমর মুশতারি সাহিত্য পদক (১৯৯০)৷

No comments: