সাঈদ আহমদ Syed Ahmed Biography 1931-
If you cannot view the fonts properly please download and Install this file.
বাংলা নাটক ও নাট্যচর্চার ইতিহাসে সাঈদ আহমদ বিশেষ ও বিশিষ্ট ব্যতিক্রম৷ দেশের নাটককে বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে নিয়ে গেছেন তিনি৷ বাংলাদেশের আধুনিক নাট্যচর্চার গোড়াপত্তনে যাঁদের নাম উল্লেখ করা অনিবার্য, হাতেগোনা সেসব ব্যক্তিদের মধ্যে সাঈদ আহমদ অন্যতম৷ উপমহাদেশের অ্যাবসার্ড নাটকের পথিকৃত্ হিসেবেও শিরোপা তাঁরই প্রাপ্য৷
নাট্যকার সাঈদ আহমদ একাধারে সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্র-সমালোচক, সংস্কৃতিবেত্তা, নির্মাতা ও অভিনেতা৷ সঙ্গীত, নাটক, চলচ্চিত্র, চিত্রকলা ও সাহিত্যের বিশ্ববরেণ্য অনেক গুণীর ঘনিষ্ট সানি্নধ্য লাভ করেছেন তিনি৷ বিভিন্ন ভাষায় তাঁর নাটক অনূদিত হয়েছে৷ বিশ্বের নামিদামি অনেক একাডেমি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন৷ নাটকের জন্য তিনি পেয়েছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সম্মান৷ বহুমুখী ও পূর্ণাঙ্গ শিল্পপ্রতিভা সাঈদ আহমদ আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন৷
সাঈদ আহমদের জন্ম ১৯৩১ সালের ১ জানুয়ারি পুরনো ঢাকার ইসলামপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে৷ নর্মাল স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন৷ ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন৷ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অন্য অনেকের মতো তাঁর শিক্ষাজীবনের ধারাবাহিকতায় এক বছরের জন্য ছেদ পড়ে৷ ফলে ১৯৪৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন এবং ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে ব্রিটেনে চলে যান৷ ১৯৫৬ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্স থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন তিনি৷
শিক্ষাজীবন শেষ করার পরপরই ১৯৫৬ সালে সরকারি চাকুরিতে যোগ দিয়ে তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান তিনি৷ স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে নিষ্ঠার সাথে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে গেছেন৷ দীর্ঘ চাকুরি জীবনে প্রথমে পাকিস্তান ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন৷
সাঈদ আহমদের পরিবার শুধু বংশপরিচয়ের দিক থেকে নয়, শিল্প-সংস্কৃতির দিক থেকেও সম্ভ্রান্ত৷ তত্কালীন ঢাকার পেশাদার নাট্যদল এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান লায়ন থিয়েটারের সাথে তাঁদের পরিবারের যোগসূত্র ছিল৷ বাবা মীর্জা এফ মোহাম্মদ ও মা জামিলা খাতুন- দুজনেই সংস্কৃতি আমোদে মানুষ৷ বাবা ও চাচার সাথে প্রখ্যাত সঙ্গীতসাধক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বন্ধুত্ব ছিল৷ সুফিবাদের গভীর তত্ত্ব নিয়ে মা জামিলা খাতুন এবং শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের মধ্যে আলোচনা বেশ জমে যেত৷ সাঈদ আহমদের পরিবারের সাথে ঢাকার সংস্কৃতিবান পরিবারগুলোর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল৷ শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমাবেশ ঘটত তাঁদের বাড়িতে৷
সাঈদ আহমদের ভাইবোনদের মধ্যে বেতার ব্যক্তিত্ব নাজির আহমদ ও চিত্রশিল্পী হামিদুর রহমান শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব৷ অন্য ভাইবোনদের মধ্যে আছেন নাসির আহমদ, মেহেরুননিসা বেগম এবং শামসুন্নাহার বেগম, লুত্ফুন্নাহার বেগম৷ ভাইদের মধ্যে কনিষ্ঠ ছিলেন সাঈদ আহমদ৷
লায়ন থিয়েটার আর পারিবারিক সংস্কৃতির আবহে ছেলেবেলাতেই সেই সময়ের প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব অর্ধেন্দু মুস্তাফি, অর্ধেন্দু শেখর, অহীন্দ্র চৌধুরী, শিশির ভাদুড়ী, মোস্তফা হোসেন, জোয়ালা প্রসাদ, ফটিকচন্দ্র নন্দী প্রমুখদের কলানৈপুণ্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল সাঈদ আহমদের৷
আজকের সাঈদ আহমদ নাটকের জন্য সমধিক পরিচিত হলেও শৈশব ও কৈশোরে- এমনকি প্রথম যৌবনেও- সঙ্গীত তাঁকে যতটা মগ্ন করে রেখেছিল নাটক ততটা মগ্ন করতে পারেনি৷ একেবারে ছেলেবেলা থেকেই অসম্ভব টান ছিল সঙ্গীতের প্রতি৷ আবৃত্তি আর গান মিলে ছিল তাঁর ছেলেবেলা৷ দশ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'পলাতকা' আবৃত্তি করে প্রথম পুরস্কার বিজয়ী হয়েছিলেন তিনি৷ স্কুলের অনুষ্ঠানগুলোতে গান গাওয়ার জন্য ডাক পড়ত হামিদুর রহমান (চিত্রশিল্পী, সাঈদ আহমদের সেজোভাই), খান আতাউর রহমান (সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব), মনসুরুল করিম এবং সাঈদ আহমদের৷ খান আতাউর রহমান ও মনসুরুল করিম ছিলেন তাঁর সহপাঠী৷ স্কুলে তাঁদের গানের শিক্ষক ছিলেন মাখন লাল চক্রবর্তী৷ তখন সাঈদ আহমদের পরিবার থাকত আজিজ লেনের ১৭ নম্বর বাড়িতে৷ বাড়ির দহলিজে আড্ডা বসাতেন মেজো ভাই নাজির আহমদ৷ সেজো ভাই হামিদুর রহমান আড্ডা বসাতেন বাড়ির ভেতরে তাঁর ছোট ঘরে৷ সাঈদ আহমদও একটি আড্ডা গড়ে তোলেন৷ তাঁর আড্ডায় বেশি আসতেন সঙ্গীতের লোকজন৷ তাঁদের বাড়িতে হামিদুর রহমানের আড্ডায় নিয়মিত ছিলেন কবি শামসুর রাহমান এবং হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল-আজাদসহ অনেক উদীয়মান শিল্পী-সাহিত্যিক৷ শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীতের বিখ্যাত লোকজনও এ বাড়ির আড্ডায় হামেশাই আসতেন৷
সঙ্গীতে সাঈদ আহমদের দখল সম্পর্কে সাঈদ আহমদের 'শেষ নবাব' নাটকের 'পূর্বলেখ' অংশে শামসুর রাহমান স্মৃতিচারণ করেছেন, বিশিষ্ট সেতারবাদক ও সঙ্গীতসাধকদের 'সুপরামর্শে সাঈদ আহমদ অল্প সময়ে একজন প্রতিশ্রুতিশীল সেতারশিল্পী হয়ে উঠেছিলেন৷' (শেষ নবাব: পূর্বলেখ, শামসুর রাহমান) কিন্তু বড়মাপের সঙ্গীতসাধক হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁকে পেয়ে বসেছিল৷ বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের পরিবারের সাথে তাঁদের পরিবারের ঘনিষ্টতা স্থাপিত হয়েছিল৷ ওস্তাদ মাস্তান গামা, ওস্তাদ খাদেম হোসেন খান ও তরুণ ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান তাঁর আড্ডায় নিয়মিত আসতেন৷ ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান ছিলেন তাঁর সমবয়সী এবং বন্ধু৷ ওস্তাদ খাদেম হোসেন খান তাঁর ওস্তাদ৷ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ তখন থাকতেন ভারতের মাইহারে৷ মাইহারে আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সেতার শিখতে গিয়েছিলেন তিনি৷ খাঁ সাহেব তাঁকে ভাইপো খাদেম হোসেন খানের কাছে তালিম নেওয়ার পরামর্শ দেন৷ খাদেম হোসেনের কাছে শেখার সময় (১৯৫২ সালে) বছরে দুইবার ঢাকায় আসতেন আলাউদ্দিন খাঁ৷ ওই সময়ে খাঁ সাহেবের কাছে দীক্ষা নেওয়ার সুযোগ ঘটত তাঁর৷ এছাড়া খাদেম হোসেনের কাছে বাসায় গিয়ে তালিম নেওয়ার সময় মাঝে মাঝেই বাজাতেন প্রখ্যাত ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ৷ আয়েত আলী খাঁর কাছ থেকেও তিনি পরোক্ষ শিক্ষা পেয়েছেন৷ সাঈদ আহমদ বাংলাদেশের ২১ জন সঙ্গীতজ্ঞের জীবন ও কর্মের পরিচিত তুলে ধরে 'বাংলাদেশের সুরস্রষ্টারা' নামের একটি সুখপাঠ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন৷ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবদের পরিবারের সন্তান সঙ্গীতজ্ঞ মোবারক হোসেন খান এ গ্রন্থের ভূমিকায় সাঈদ আহমদ সম্পর্কে লিখেছেন, 'এমনকি, সুরস্রষ্টাদের সারিতে তাঁর নামও আমি নিজের লেখা দিয়ে সংযোজন করে দিতে পারি৷'
সাঈদ আহমদ ১৯৫১ সালে পাশ্চাত্যের ধাঁচে একটি সঙ্গীতের দল গড়ে তোলেন৷ তাঁর সে দলের নাম ছিল 'সাঈদ আহমদ অ্যান্ড পার্টি'৷ বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে ইলেক্ট্রিক গিটার নিয়ে আসেন তিনি৷ তাঁর দলে ইলেক্ট্রিক গিটার বাজাতেন ওয়ারেস আলী খান৷ গিটার শেখার জন্য তিনিই ওয়ারেস আলীকে পাঠিয়েছিলেন কলকাতায় গিটার বাদক সুজিত নাথের কাছে এবং পরে শান্তি নিকেতনে চীন জো রে জির কাছে৷ ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত রেডিও পাকিস্তানে সেতার ও অর্কেস্ট্রা বাদন পরিবেশন করেন তিনি৷ রেডিওর সেসব অনুষ্ঠানের জন্য স্ক্রিপ্ট করতেন কবি শামসুর রাহমান এবং সুর করতেন তিনি৷ তাঁদের পরিবেশনা 'সোনার কাঠি, রুপার কাঠি' 'সৃষ্টি' এবং 'এরা নির্ভিক যাত্রী' সে সময় জনপ্রিয় হয়েছিল৷ সাঈদ আহমদ তাঁর এ অনুষ্ঠান সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে বলেন, ''এরা নির্ভীক যাত্রী'তে ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকায় কর্তৃপক্ষ আপত্তি তোলে৷ পরে ওই স্ক্রিপ্টে মরুভূমির প্রেক্ষাপট জুড়ে দিই৷ আর সবই ঠিক থাকে৷ এতে করে শ্রোতারা যা বোঝার ঠিকই বুঝেছিল৷''
লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিক্স পড়ার সময় সাঈদ আহমদের শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক মেনিং৷ প্রফেসর মেনিংয়ের কাছে স্কুল অব ইকনোমিক্স পড়ার পাশাপাশি লন্ডনের মর্লি কলেজ অব মিউজিকয়ে সঙ্গীত শেখার অনুমতি চাইলেন৷ মেনিংয়ের ছেলে ছিলেন সাঈদ আহমদের বন্ধু৷
বন্ধুর বাবা হওয়া সত্ত্বেও মেনিং তাঁর এই ছাত্রকে গানের কলেজে ঢোকার অনুমতি দিতে চাইলেন না৷ ছাত্রও যে বড় একরোখা৷ গানের কলেজে সে যাবেই৷ প্রয়োজনে ছেড়ে দেবে কলেজ অব ইকনোমিঙ্৷ বাধ্য হয়ে অনুমতি দিলেন মেনিং৷ সপ্তাহে তিনদিন মর্লি কলেজে মিউজিক শিখতেন সাঈদ আহমদ৷ ওস্তাদদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত বেহালাবাদক ইয়াহুদি মেনইউহিন৷ সে সূত্রে পরিচয় হয়েছিল মেনইউহিনের চার বছরের ছোট বোন বিশিষ্ট পিয়ানোবাদক ইয়াহুদি হেপজিবাহ্র সাথে৷ তাঁদের এ পরিচয় গভীর বন্ধুত্বে রূপ নিয়েছিল৷
সাঈদ আহমদের সঙ্গীত চেতনা গড়ে উঠেছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সঙ্গীতের সংমিশ্রণে৷ একদিকে ভারতীয় সঙ্গীতের দীর্ঘ কালের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার, অন্যদিকে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রায় তেমনি এক সুদীর্ঘ সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য৷ এ দুয়ের সাথে ইউরোপের সামপ্রতিক সঙ্গীতের বিশিষ্টতা মিলে সাঈদ আহমদের নিজস্বতা গড়ে ওঠে৷
রেডিও পাকিস্তানে অর্কেস্ট্রা বাদন ছাড়াও বিবিসিতে সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন তিনি৷ ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিবিসির সাথে৷ বিবিসির উপমহাদেশীয় বিভিন্ন ভাষার অনুষ্ঠানে সেতার বাদন ও অর্কেস্ট্রা পরিবেশন করেছেন৷ লন্ডনের বিভিন্ন থিয়েটার ও কনসার্ট হলে সঙ্গীত পরিবেশন করেন তিনি৷ ১৯৫৫ সালে প্যারিসের 'মুজি গিমেট\'য়ে আমন্ত্রিত হয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করেন সাঈদ আহমদ৷ ফ্রান্স টেলিভিশনে সে অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়৷ ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে ভারতীয় নৃত্যদলের সাথে সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব হিসেবে সাঈদ আহমদ পশ্চিম জার্মানি, স্পেন ও ইতালি সফর করেন৷
যৌবনের দামাল দিনগুলোতে সাঈদ আহমদ বিমগ্ন ছিলেন সঙ্গীতে৷ সঙ্গীতের লোক বলেই জানতেন তাঁকে সবাই৷ নাট্যকার হিসেবে সাঈদ আহমদের আবির্ভাব অনেকটা 'হঠাত্ আলোর ঝলকানির মতো' ( 'শেষ নবাব' নাটকের পূর্বলেখ অংশে শামসুর রহমান)৷ যদিও ছেলেবেলায় নাটক দেখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নাটকে অভিনয় করেছেন৷ উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজনে ইউরোপে থাকার সময় নাটক দেখা ও অভিনয় দুটোই করেছেন তিনি৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সময় মোকসুদ আলীর 'ইউরেকা' নাটকে প্রথম অভিনয় করেন৷ পরে তিনি শেক্সপিয়রের নাটক 'মার্চেন্ট অব ভেনিস'সহ অভিনয় করেন 'অবাক জলপান', 'শেষরক্ষা' ইত্যাদি নাটকে৷ এর পরে লন্ডনে থাকার সময় অভিনয় করে 'আ কিং ইজ বর্ন' নাটকে৷ শ্বেতাঙ্গদের ভিড়ে এই নাটকে তিনিই একমাত্র অসবর্ণ অভিনেতা৷ ঢাকা ও লন্ডনে ছাত্রাবস্থায় অভিনয়ের পাশাপাশি নাটকের জন্য সঙ্গীত ও অন্যান্য বিষয় নিয়েও কাজ করেছেন সাঈদ আহমদ৷
তখনই হয়ত তাঁর মনে গোপনে নাটকের বীজ বোনা হয়ে গিয়েছিল৷ ফসল ফলল ১৯৫৬ সালে৷ তখন সদ্য সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে লাহোরে থাকছেন৷ চাকরির রুটিন মাফিক জীবন এবং বান্ধববর্জিত লাহোরে বসবাসের নিঃসঙ্গতা তাঁকে তখন ভালোভাবেই পেয়ে বসেছে৷ একাকীত্বের ওই দিনগুলোতে তিনি লিখে ফেললেন নাটক 'নট আই'৷ 'নট আই' সম্পর্কে নাট্যপত্রিকা 'থিয়েটারওয়ালা'র সাথে এক সাক্ষাত্কারে সাঈদ আহমদ বলেন, ' ৫৬ সালে আমি লাহোরে ফিরে এলাম (লন্ডন থেকে)৷ ১৯৫৭ সালে আমি একটা নাটক লিখলাম৷ নাটকের বিষয়বস্তু হল নট আই, মানে- আমি না৷ ...মানে আমি আমাকে চিনি না৷... নট আই ওয়াজ মাই ফার্স্ট ড্রামা৷ সফদার মীর আমার বন্ধু ছিল... সে বোম্বেতে নাটক করত আর শম্ভু মিত্রের সাথে গণনাট্য সংঘ করত৷... ও বলল যে, এটা কী লিখেছ, আমি বুঝি না৷ তবে এটা ভালোই হতে পারে৷ বলল, আমাদের বন্ধু সাকের আলীকে দেখাও৷ সাকের আলী ওয়াজ এ গ্রেট অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টার৷ ম্যাইয়ো কলেজের আর্টসের টিচার ছিলেন৷ সদ্য বিলেত ফেরত টিচার৷ তো সাকের আলীকে দেখালাম৷ তো বললেন যে, এটা ভালোই হয়েছে, কিন্তু মন্তব্য করব না কারণ, আমি বুঝতে পারিনি৷ এর পর আমি একদিন এটা ছিঁড়ে ফেললাম... স্ক্রিপটা আবার শুরু করব... এ সময় আমি করাচিতে বদলি হয়ে গেলাম৷'
করাচিতে দুই কামরার বাসা৷ বিকেলে অফিস থেকে ফিরে কোনও কাজ থাকে না৷ সরকারি চাকরিতে একজন বাঙালি কর্মকর্তা হিসেবে তিনি তখন কোণঠাসা অবস্থায়৷ ওই সময় করাচিতে গেলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন৷ কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে হাজির হলেন শিল্পী হামিদুর রাহমান ও মুর্তজা বশীর৷ এদের সাথে এসে যোগ দিলেন করাচির বিখ্যাত চিত্রকর সাদেকাইন৷ দুই কামরার বাসার পক্ষে যথেষ্ট ভীড়৷ সারা দিন পেইন্টিং, আড্ডা, হট্টগোল লেগেই আছে৷ বিরক্ত হয়ে পড়লেন সাঈদ আহমদ৷ অফিস থেকে ফিরে বাসায় আর নিজের কাজ বলে কিছুই করা হচ্ছিল না তাঁর৷ তো একদিন তিনি রেগেই গেলেন খুব৷ জয়নুল আবেদিন ও হামিদুর রাহমানও রেগে অন্য ঘরে চলে গেলেন এবং সাদেকাইন ফিরে গেলেন নিজের বাসায়৷ সাঈদ আহমদ তাঁদের বললেন- 'আমি দরজা বন্ধ করে কাজ করব৷ আপনারা হৈচৈ করবেন না৷' দরজা বন্ধ করে লিখতে বসে গেলেন তিনি৷ একটানা রাত আটটা পর্যন্ত লিখলেন৷ লিখলেন ইংরেজিতে৷ প্রায় সাতদিনে এ লেখাটি একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক হয়ে উঠল৷ নাটকের নাম রাখলেন 'দ্য থিং'৷ ১৯৬১ সালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী গোর্কির প্রেক্ষাপটে রচিত হয় এ নাটক৷ একই বছরে তাঁর লেখা এই ইংরেজি নাটক তিনি পড়ে শোনালেন জয়নুল আবেদিন ও হামিদুর রাহমানকে৷ জয়নুল আবেদীন শুনে মন্তব্য করলেন, 'এই নাটক খুব মুশকিলের৷ আমি তেমন বুঝতে পারি নাই৷ তবে আমি এটির প্রচ্ছদ করব৷' শিল্পাচার্য এ নাটকের প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেছিলেন, প্রচ্ছদটি অাঁকা হয়নি তাঁর৷ সাঈদ আহমেদের 'দ্য থিং' যখন লেখা হয় তখনও বাংলায় তো নয়ই উপমহাদেশেও অ্যাবসার্ডধর্মী কোনও নাটক রচিত হয়নি৷ সাঈদ আহমদের সমসাময়িক পশ্চিমবঙ্গের নাট্যকার বাদল সরকার অ্যাবসার্ডধর্মী নাটক 'এবং ইন্দ্রজিত্' রচনা করেন আরও এক বছর পরে (১৯৬২ সালে)৷
ওই বছরই আমেরিকা থেকে করাচিতে আসে মেইন বিশ্ববিদ্যালয়ের 'মেইন মাসকুইয়ার্স' দল৷ তখন নাট্যকার হিসেবে দলনেতা ড. হারশালের সাথে পরিচয় হয় সাঈদ আহমদের৷ করাচিতে এ দলের পরিবেশনায় 'দ্য থিং' মঞ্চস্থ হয়৷ নাটকটি বাংলায় 'কালবেলা' নামে মঞ্চায়নের ব্যবস্থা নেয় ড্রামা সার্কল৷ গ্রুপ থিয়েটারের পথিকৃত্ নাট্যসংগঠনগুলোর অন্যতম 'ড্রামা সার্কল' অ্যাবসার্ডধর্মী প্রথম নাটকটিকে মঞ্চে জীবন্ত করে তোলে৷ এক্ষেত্রে নাটকের বাংলা অনুবাদ নাট্যনির্দেশক বজলুর রহমান ও নাট্যকার নিজে করেন৷ পরে নাট্যকার নিজে আরও পরিমার্জন ও সংশোধন শেষে এটিকে মুদ্রণ মাধ্যমের উপযোগী করে তোলেন এবং 'পরিক্রম' নামের একটি সাহিত্যপত্রে সেটি প্রকাশিত হয়৷ ১৯৬২ সালের জুলাই মাসে ড্রামা সার্কল ঢাকার তোপখানা রোডে তত্কালীন ইউসিস মিলনায়তনে এটি মঞ্চস্থ করে৷ 'কালবেলা' নাটকটি বেশকিছু ভাষায় অনূদিত এবং বিদেশে মঞ্চস্থও হয়েছে৷
সাঈদ আহমদের পরবর্তী নাটক 'মাইলপোস্ট'৷ 'মাইলপোস্ট' নাটকটিও লেখা শুরু করেন পাকিস্তানের লাহোরে থাকার সময়৷ ১৯৬৪ সালে 'মাইলপোস্ট' রচনা করেন তিনি৷ দুর্ভিক্ষের বিষয়গত প্রেক্ষাপটে অধিবাস্তবিক (অ্যাবসার্ড) কলাকৌশল প্রয়োগ করে তিনি রচনা করেন মাইলপোস্ট৷ 'মাইলপোস্ট' নাটকটিও প্রথমে ইংরেজিতে লেখেন তিনি৷ পরবর্তীতে এটির প্রথম অনুবাদ করেন নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান৷ নাট্যকার আশকার ইবনে শাইখের নেতৃত্বাধীন সাতরং নাট্যগোষ্ঠীর জন্য এটি বাংলায় অনুবাদ করা হয়৷ ১৯৬৫ সালের মে মাসে বাংলা একাডেমী আয়োজিত নাট্য মৌসুমে সাতরং নাট্যগোষ্ঠী বাংলা একাডেমী মিলনায়তনে এটি প্রথম মঞ্চস্থ করে৷ পরবর্তীতে এ নাটকটিও বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত এবং বিদেশে মঞ্চস্থ হয়েছে৷
সাঈদ আহমদের তৃতীয় নাটক 'তৃষ্ণায়'৷ ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এ নাটকটি রচনা করেন তিনি৷ প্রথমত এ নাটকটি বাংলায় লেখা হয় এবং পাশাপাশি নাট্যকার নিজে এটির ইংরেজি অনুবাদ করেন৷ ইংরেজি সাপ্তাহিক 'হলিডে-তে 'তৃষ্ণায়' নাটকের ইংরেজি 'দ্য সারভাইভাল' প্রকাশিত হয়৷ ১৯৬৯ সালে বাংলা একাডেমী 'তৃষ্ণায়' নাটকটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে৷ বাংলাদেশের জনপ্রিয় লোককাহিনী শিয়াল ও কুমীর ছানার গল্পকে উপজীব্য করে এ নাটকটি রচিত৷ অস্তিত্বের সংগ্রামে সুচতুর শেয়ালের কাছে মার খাওয়া কুমীরের গল্প এ নাটকে বিনির্মিত হয়ে আরও ব্যাপকতর মাত্রা পায় এবং সামগ্রিক জীবনবোধ নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়৷ বাংলাদেশে লোককাহিনী নিয়ে শিশুতোষ নাটকের বাইরে কোনও নাটক তিনিই প্রথম রচনা করেন৷ এ নাটকটিও একাধিক ভাষায় অনূদিত ও বিদেশে মঞ্চস্থ হয়৷ ব্যতিক্রম নাট্যগোষ্ঠী নাটকটি বাংলাদেশে প্রথম মঞ্চস্থ করে৷ ১৯৬৭ সালে 'তৃষ্ণায়' পাঞ্জাবি অনুবাদ 'জঙ্গল গা রাখা' মঞ্চস্থ হয় লাহোরে৷ সরকারি চাকরিসূত্রে সাঈদ আহমদ তখন লাহোরে৷ লাহোর, করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও পেশোয়ারে এর আগেও তাঁর নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে৷ নাটকটির পাঞ্জাবি অনুবাদ করেন নাজম হোসেন সাঈদ ও পরিচালনা করে লাহোরের মজলিস শাহ হোসেন একাডেমি৷ নাটকটি দেখার জন্য প্রতিদিন দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়৷ এক সপ্তাহ চলার পর লাহোরের কমিশনার সাঈদ আহমদকে ডেকে পাঠালেন৷ কমিশনারের সাথে তাঁর বেশ বন্ধুত্ব ছিল, কিন্তু ওইদিন তিনি বন্ধুত্ব দেখালেন না৷ কী করলেন? তা সাঈদ আহমদের কাছ থেকেই শোনা যাক: 'কমিশনার গম্ভীর হয়ে বললেন, নাটকে আপনি ইয়াহিয়া খানকে কটাক্ষ করেছেন৷ এর সাজা আপনাকে নিতে হবে৷ আমি বললাম- আমি তো জেনে করিনি৷ তাছাড়া এ তো জানোয়ারকা কাহানি হ্যায় জানোয়ার বলতা হ্যায়৷ একটা নাটকের আর কী এমন দাম৷ কিন্তু এসব কথায় তিনি দমবার পাত্র নন৷ বহুত লোক দেখছে, অ্যান্টি প্রপাগান্ডা হয়ে যাচ্ছে৷ এ নাটক মঞ্চায়নের আগে আপনি অনুমতি নেননি৷ কেন অনুমতি না নিয়ে মঞ্চায়ন করলেন? বললাম- অনুমোদনের ব্যাপারটি আমার জানা ছিল না৷ সেবার এসব বলে টলে পার পেয়েছিলাম এবং চাকরিটাও রক্ষা হয়েছিল৷ কিন্তু নাটকটির শো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ঠিকই৷'
সাঈদ আহমদের চতুর্থ নাটক 'প্রতিদিন একদিন'৷ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় এ নাটক রচনা করেন তিনি৷ এ নাটকে তিনি অধিবাস্তব প্রকরণ-শৈলীর বাইরে বেরিয়ে আসেন৷ ১৯৭৫ সালে এ নাটক রচিত হয়৷ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনে নেমে আসা চরম অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরেন৷
সাঈদ আহমদের লেখা পঞ্চম নাটক 'শেষ নবাব'৷ ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ দশ বছর এ নাটক রচনায় নিয়োজিত থাকেন তিনি৷ এর আগে আর কোনও নাটক রচনায় এত সময় নেননি সাঈদ আহমদ৷ নবাব সিরাজদ্দৌলাকে নিয়ে তার আগে (১৯৪৭ সাল থেকে) এক ডজনের বেশি নাটক লেখা হয়ে গেছে৷ এর মধ্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও শচীন সেনগুপ্তের লেখা দুটি নাটক বেশ জনপ্রিয়৷ তার সামনে ছিল এসব নাটকের চ্যালেঞ্জ৷ সে চ্যালেঞ্জের সফল মোকাবেলা তার 'শেষ নবাব'৷
সাঈদ আহমদ আরও একটি ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা রেখেছেন৷ বাংলাদেশের চিত্রকলা নিয়ে লেখালেখি, চিত্রকলার সমালোচনা শুরুই করেন তিনি৷ চিত্রকলা নিয়ে লেখালেখির শুরু করাচিতে থাকাকালে৷ এর আগে অবশ্য লন্ডনে থাকার সময় সেজোভাই চিত্রশিল্পী হামিদুর রাহমান সেখানকার আর্ট কলেজে পড়তেন৷ সাঈদ আহমদও সেখানে যেতেন৷ আড্ডা হত ইন্ডিয়ান ক্রাউডের সাথে৷ ওরাই তাঁকে পরামর্শ দিল আর্টের ওপর একটা কোর্স করে ফেলার৷ তিনমাসের একটা কোর্স করে নিলেন৷ এরপর বিশ্বের বিখ্যাত চিত্রকর্ম উপলব্ধির জন্য তাঁর চোখ খুলে গেল৷ চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, হামিদুর রহমান, মুর্তজা বশীর, সাকের আলী, সাদেকাইন প্রমুখদের কথা আগেই উল্লেখ করেছি৷ তাঁদের সংস্পর্শ ও আড্ডা তাঁকে আর্ট নিয়ে লেখার শক্তি দিয়ে গেল৷ তখন পাকিস্তানের 'ডন' ও 'মর্নিং নিউজ' পত্রিকায় লিখতেন তিনি, আলতাফ গওহর, আমজাদ আলী আর জালালউদ্দিন আহমেদ৷
১৯৬৪ সালে লাহোরে এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে গ্রে ফাউন্ডেশন৷ আর্টের ওপর বক্তব্য রাখার জন্য সেখানে তাঁকে ডাকেন মিসেস গ্রে৷ তিনি বললেন শিল্পের জন্য শিল্পের পক্ষে আর তাঁরই বন্ধু সফদার মীর বললেন মানুষের জন্য শিল্পের পক্ষে৷ দুজনের মধ্যে এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক৷ 'পাকিস্তান টাইমস' পত্রিকার ক্রিটিক ছিলেন সফদার মীর৷ বিতর্ক চলল দীর্ঘ ছয়মাস ধরে৷ বিভিন্ন পত্রিকায় পক্ষে বিপক্ষে লিখে চললেন তাঁরা৷ শেষ পর্যন্ত জিত হল শিল্পের জন্য শিল্পের৷ সাঈদ আহমদ পাকিস্তানের ১৫ বছরের এবং পরে বাংলাদেশের ১৪ বছরের চিত্রকলার সুলোক সন্ধান নিয়ে সংকলন ও সংগ্রহ সম্পাদনা করেছেন৷ বাংলাদেশের চিত্রকলার ওপর লেখা নিয়ে সাঈদ আহমদের বেশকিছু গ্রন্থ ও মনোগ্রাফ প্রকাশিত হয়েছে৷ চিত্রশিল্পী হামিদুর রহমানকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ বাংলা এবং ইংরেজিতে রচনা করেছেন তিনি৷ চিত্রকলার বিষয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিশ্লেষণ ও বিবরণে সমৃদ্ধ এসব সমালোচনা কর্মে তিনি তার শক্তিমত্তার প্রকাশ দেখিয়েছেন৷ চিত্রকলা নিয়ে তাঁর লেখালেখি দেশের বাইরে পাকিস্তান, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, চীন, জাপান এবং ব্রাজিল থেকে প্রকাশিত হয়েছে৷ এসব দেশের শিল্পকলা একাডেমিতে চিত্রকলা নিয়ে বক্তব্যও দিয়েছেন তিনি৷
দৃশ্যনির্ভর মাধ্যমের জন্য করা সাঈদ আহমদের অন্যতম কর্ম 'বিশ্বনাটক'৷ বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য ১৯৮২ সাল থেকে টানা দশ বছর ধরে দর্শকনন্দিত এ অনুষ্ঠান করেছেন তিনি৷ বিশেষ একটি দেশের নাটকের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আলোচনার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূত্রপাত করতেন তিনি৷ তারপর দর্শকদের একটি ভূমিকা দিয়ে ওই দেশের উল্লেখযোগ্য একটি নাটক দেখাতেন৷ অনুষ্ঠানটি ছিল ৫০ মিনিটের৷ বছরে ১২ টি করে বিশ্বের মোট ৭১ টি নাটক এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি উপস্থাপন করেন৷
এ অনুষ্ঠান ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ আছে সাঈদ আহমদের৷ ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি হংকং, তাসখন্দ, ব্যাংকক, কোপেন হ্যাগেন, স্টকহোম, কুয়ালালামপুর, করাচী, লাহোর, পশ্চিম বার্লিন, ইস্তানবুল, কলকাতা, দিল্লি, ওসলো, বেজিং, আমস্টারডাম এবং ভুপালের বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে অংশ নেন৷
সাঈদ আহমদের স্ত্রী পারভীন আহমদ৷ বাংলাদেশের নারীদের সম্ভাবনা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, গ্রামীণ নারী শিক্ষা, নারী ও গ্রামীণ অর্থনীতি এবং হস্তশিল্প বিষয়ে পারভীন আহমদের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গবেষণা রয়েছে৷ পারভীন আহমদের লেখা সবই ইংরেজিতে৷ বাংলাদেশের নকশি কাঁথা নিয়ে তার একটি উন্নতমানের গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে৷ পারভীন আহমদ বাংলাদেশ এবং এশিয়ার নকশি কাঁথার ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনুসন্ধান নিয়ে ব্যস্ত৷
বাংলাদেশের শিল্পকলার বিশ্বকন্ঠস্বর সাঈদ আহমদ সফর করেছেন বলতে গেলে সারা পৃথিবী৷ কোন দেশে গিয়েছেন তিনি তা বলার চেয়ে বরং কোন দেশে যাননি তিনি তা-ই বলা সহজ৷ ইউরোপ দিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁর বিশ্বপরিক্রমা৷ লন্ডনে পড়াশুনা করতে গিয়ে পাঠ নিয়েছিলেন সঙ্গীত ও চিত্রকলার৷ পরবর্তীতে চাকরিসূত্রে পাকিস্তানের করাচি ও লাহোরে৷ সঙ্গীত ও শিল্পকলার ওপর বক্তৃতা করতে গিয়েছেন ভারতে৷ এসবই ঘটেছিল তাঁর দামাল যৌবনে৷ তাঁর সুবিস্তৃত ভ্রমণসূচির মধ্যে রয়েছে জার্মানি, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, থাইল্যান্ড, হংকং, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, তুরস্ক, বুলগেরিয়া, সুইডেন, ডেনমার্ক, ব্রিটেন৷
কখনও ভারতীয় সঙ্গীত ও সংস্কৃতির প্রতিনিধি হয়ে, কখনও নাট্যকার হিসেবে, কখনও আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক উত্সবের জুরি হিসেবে, কখনও টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা হিসেবে, কখনও বিশ্বের প্রখ্যাত কোনও একাডেমি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রিত শিক্ষক হিসেবে সাঈদ আহমদকে যেতে হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে৷
দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও নাট্যকলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত৷ শিল্পকলা বিষয়ে পড়িয়েছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে৷ দেশের বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান ইউনিভার্সিটি ও জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি, থাইল্যান্ডের চুলালংকর্ন ইউনিভার্সিটি, ওসলো ইউনিভার্সিটি, ভারতের ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটকের ক্লাসে পড়িয়েছেন তিনি৷ এসবের বাইরেও মস্কো, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, হংকং, কুয়ালালামপুর, টোকিও, তাসখন্দ, কোপেনহ্যাগেন, স্টকহোম, কলোন, প্যারিস, রিয়োডি জেনিরো, পূর্ব বার্লিনসহ আরও অনেক শহরের একাডেমি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হয়েছেন তিনি নাটক সম্পর্কে আলোচনার জন্য৷
শিল্প-সংস্কৃতির পথে জীবনব্যাপী যাত্রা সাঈদ আহমদের৷ তাঁর লেখা, বাগ্মিতা, সুর ও সঙ্গীত দিয়ে বাঙালির সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখাকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি৷ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেশ ও বিদেশের বহু পুরস্কার, পদক, সম্মাননা তো আছেই, সেসাথে রয়েছে তাঁর জন্য সবার অফুরন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা৷
বাংলা নাটকে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার৷ নাট্যকার সাঈদ আহমদের সম্মানে ১৯৭৬ সালে ওয়াশিংটন ডিসির প্রখ্যাত নাট্যশালা এরিনা স্টেজের দর্শকাশনের একটি সারিতে নামাঙ্কন করা হয়৷ ১৯৭৮ সালে পেয়েছেন সুফী মোতাহার হোসেন পুরস্কার৷ ১৯৮৩ সালে জার্মানির বার্লিন টিভি ড্রামা উত্সবে তাঁকে 'প্রিঙ্ ফিউচুরা' পদক প্রদান করা হয়৷ যুক্তরাষ্ট্রের সিকাগো থেকে মার্কুইজ হুজ হু পাবলিকেশন বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত 'হুজ হু ইন দ্য ওয়ার্ল্ড' (সপ্তম সংস্করণ ১৯৮৪-১৯৮৫) গ্রন্থে নাট্যকার হিসেবে তাঁর পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে৷ ফরাসি সরকার ১৯৯৩ সালে তাঁকে সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার 'লিজন দ্য অনার' সম্মানে ভূষিত করে৷ দেশের অন্যতম নাট্যচর্চা সংগঠন নাগরিক নাট্য সমপ্রদায় ১৯৯৬ সালে 'দক্ষিণ এশিয়া পদক' প্রদান করে৷ ১৯৯৭ সালে তিনি মুনীর চৌধুরী পদক লাভ করেন৷ ১৯৯৮ সালে মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রকফেলার ফাউন্ডেশন সাঈদ আহমদকে 'রেসিডেন্ট প্লেরাইট' নিয়োগ করে৷ ২০০৮ সালে ঢাকা আর্টস সার্কেল তাঁকে সম্মাননা প্রদান করে৷
তথ্যসূত্র:
১. সাঈদ আহমদ এবং পারভীন আহমদের সাথে সরাসরি কথাবার্তা; সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০০৬
২. 'আলাপনে নাট্যকার সাঈদ আহমদ'/ সাক্ষাত্কার: শফি আহমদ ও হাসান শাহরিয়ার: নাট্যপত্রিকা 'থিয়েটারওয়ালা'- ২০০৫
৩. 'নাট্যকার সাঈদ আহমদ: একটি মূল্যায়ন'/ মুস্তাফিজুর রহমান সৈয়দ: শিল্পকলা একাডেমি পত্রিকা
৪. 'বাংলাদেশের নাটকে রাজনীতি ও সমাজ সচেতনতা'/ সৈয়দা খালেদা জাহান: বাংলা একাডেমী
৫. 'কালের ধুলোয় লেখা'/ শামসুর রাহমান
৬. 'বাংলাদেশের সুরস্রষ্টারা'/ সাঈদ আহমদ/ সাহিত্য প্রকাশ
৭. 'শেষ নবাব'/ সাঈদ আহমদের নাটকের শামসুর রাহমান লিখিত ভূমিকা- 'পূর্বলেখ'/ শিল্পকলা একাডেমি
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment