আবু ইসহাক Abu Ishaq Biography 1926-2003
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রগুলোর একটির নাম আবু ইসহাক৷ শুধু কথাসাহিত্যিকই নন বিশিষ্ট অভিধান প্রণেতার অভিধাও তাঁর প্রাপ্য৷ বাংলা সাহিত্যে যাঁরা লিখেছেন কম, কিন্তু যা লিখেছেন তা অসাধারণ, তাঁদেরই একজন তিনি৷ সাহিত্য যেহেতু সংখ্যার তোয়াক্কা করে না, তাই অল্প লিখেও বাংলাসাহিত্য ও বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে শীর্ষস্থানে চলে এসেছেন তিনি৷
If you cannot view the fonts properly please download and Install this file.
জন্ম ও বংশ পরিচয়
১৯২৬ সালের ১ নভেম্বর (১৫ কার্তিক ১৩৩৩ বাংলা) শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানাধীন শিরঙ্গল গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন আবু ইসহাক৷ তাঁর বাবা মৌলভি মোহাম্মদ এবাদুল্লাহ ব্যবসা করতেন৷ এছাড়া গ্রামের কিছু কৃষি জমির মালিকও ছিলেন মোহাম্মদ এবাদুল্লাহ৷ আবু ইসাহাকের মা আতহারুন্নিসা ছিলেন সাধারণ একজন গৃহবধূ৷ ছয় ভাইবোনের মধ্যে আবু ইসহাক ছিলেন পঞ্চম৷ আবু ইসহাকের বাবা ব্যবসায়ী হলেও শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল৷ ছেলেমেয়েদের মানসিক বিকাশের কথা চিন্তা করে তিনি ওই সময়ের বিখ্যাত দুটি বাংলা সাময়িকপত্রের গ্রাহক হয়েছিলেন৷ নিয়মিত গ্রাহক হওয়ায় 'সওগাত' ও 'দেশ' পত্রিকা নিয়মিত পেতেন আবু ইসহাকের ভাইবোনেরা৷
শিক্ষা
আবু ইসহাক ১৯৪২ সালে শরীয়তপুর জেলার অন্তর্গত উপসী বিজারী তারাপ্রসন্ন ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বৃত্তি নিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ ১৯৪৪ সালে ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি৷ সময়টি ছিল বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বের জন্যই গভীরতর সংকটের৷ একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর অন্যদিকে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির রাজনীতি৷ পারিবারিক আর্থিক সংকট ও রাজনীতিবিদদের উত্সাহে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই আবু ইসহাক চাকরিতে যোগ দেন৷ চাকরিতে থাকাকালে ১৯৬০ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেন৷
পেশা
আবু ইসহাক ১৯৪৪ সালে সরকারের বেসরকারি সরবরাহ বিভাগে পরিদর্শন পদে যোগদান করেন৷ দেশভাগের পর এই বিভাগ বিলুপ্ত হলে ১৯৪৯ সালে তাঁকে পুলিশ বিভাগে সহকারী পরিদর্শক হিসেবে আত্মীকরণ করা হয়৷ ১৯৫৬ সালে পুলিশ বিভাগের পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে করাচিতে চলে যান৷ ১৯৬৬ সালে তাঁকে রাওয়ালপিন্ডিতে বদলি করা হয়৷ ১৯৬৭ সালে তাঁকে বদলি করা হয় ইসলামাবাদে৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএনআই) উপ-পরিচালক পদে যোগ দেন৷ ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বার্মার (মিয়ানমার) আকিয়াবে বাংলাদেশ কনসুলেটে ভাইস-কনসাল হিসেবে নিয়োগ দান করেন৷ ১৯৭৬ সালে কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনে প্রথম সচিব হিসেবে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়৷ ১৯৭৯ সালে দেশে ফিরে তিনি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার খুলনা বিভাগের প্রধান হন৷ ১৯৮৪ সালের ১ নভেম্বর এই পদ থেকেই অবসর গ্রহণ করেন তিনি৷
শখ
আবু ইসহাকের শখ ছিল মাছ ধরা, শিকার করা এবং মৌমাছি পালন৷ এছাড়া আড্ডাপ্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি৷ করাচিতে থাকাকালে সমমনা পড়ুয়া বাঙালিদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন 'প্রবাসী পাঠকচক্র'৷ পাঠকচক্রের সদস্যদের বাসায় প্রতিমাসে চক্রাকারে আড্ডা বসত৷
সংসার ও সন্তান
আবু ইসহাক দাম্পত্যজীবন শুরু করেন ১৯৫০ সালে৷ পাকিস্তানে থাকাকালে স্ত্রী সালেহা ইসহাক ছিলেন ইসলামাবাদ সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের শিক্ষিকা৷ দেশে ফেরার পর শিক্ষকতা করেছেন মতিঝিল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে৷ বর্তমানে তিনি অবসর জীবন কাটাচ্ছেন৷ আবু ইসহাক ও সালেহা ইসহাক দম্পতির তিন সন্তান৷ আবু ইসহাক ছেলেমেয়েদের দশম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো প্রাইভেট টিউটর না দিয়ে নিজেই পড়াশোনায় সহযোগিতা করেছেন৷ সন্তানদের মধ্যে বড় কন্যা আভা নাসরিন বর্তমানে প্রবাসী৷ থাকেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে৷ মেঝো পুত্র মুশতাক কামিল প্রকৌশলী৷ বর্তমানে ঢাকায় একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক৷ ছোট পুত্র ড. ইশতিয়াক জামিল লোক প্রশাসনের অধ্যাপক৷ বর্তমানে নরওয়ের বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত৷ মেঝো ছেলে মুশতাক কামিলের পরিবারের সঙ্গেই আছেন আবু ইসহাকের স্ত্রী সালেহা ইসহাক৷
মুক্তিযুদ্ধ
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে না থাকলেও বাঙালি হওয়ার কারণে আবু ইসহাককে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে৷ ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁচার চেষ্টায় লড়তে হয়েছে তাঁকে৷ পাকিস্তানে আটকে পড়া অবস্থা থেকে আবু ইসহাক বহু কষ্টে পালিয়ে যান আফগানিস্তানে৷ ভারত ও আফগানিস্তান সরকারের সহায়তায় ১৯৭৩ সালে কাবুল ও নয়াদিল্লি হয়ে দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন তিনি৷ স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন৷ পাকিস্তানে 'বাঙালি রিপ্যাট্রিয়েশন কমিটি'র কর্মকর্তা ছিলেন তিনি৷ পাকিস্তানের জেলে আটকে পড়া বাঙালিদের ছাড়িয়ে আনার জন্য আইনি সহযোগিতা থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে সাহায্য করার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন আবু ইসহাক৷
আবু ইসহাকের সাহিত্যিক হয়ে ওঠা
বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের গ্রামগুলোর অধিকাংশই ছিল অনগ্রসর৷ এক্ষেত্রে খানিকটা ব্যতিক্রম ছিল নড়িয়া গ্রাম৷ নড়িয়ায় তখন বেশকিছু সম্পন্ন ও সংস্কৃতিমনা পরিবার ছিল৷ এসব পরিবারের সাথে আবু ইসহাকদের পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল৷ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাজকর্ম কর্মসূচির অন্যতম সহযোগী সুধীরচন্দ্র কর ছিলেন নড়িয়া গ্রামের সন্তান৷ আবু ইসহাকের সহপাঠী ছিলেন সুধীরচন্দ্র করের ছোটভাই সুভাষচন্দ্র কর৷ সহপাঠী সুভাষের মাধ্যমে তাঁদের পারিবারিক সংগ্রহ থেকে অনেক বইপত্র পড়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি৷ আবু ইসহাকের বড়ভাইয়ের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল প্রতিবেশী জমিদার বাড়ির ছেলে ফুটবলার গোষ্ঠ পালের৷ গোষ্ঠ পালদের বিশাল পারিবারিক লাইব্রেরি থেকে বইপত্র ধার নেওয়ার সুযোগ পেতেন আবু ইসহাক৷ এছাড়া আবু ইসহাকদের স্কুলের (উপসী বিজারি তারাপ্রসন্ন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়) লাইব্রেরিতে সমকালীন পত্রপত্রিকা ও বইপুস্তক ছিল৷ এখান থেকেও বইপত্র পড়ার সুযোগ পেতেন তিনি৷ শৈশব ও কৈশোরে পত্রপত্রিকা ও পুস্তক পাঠের এসব সুযোগ সাহিত্যিক আবু ইসহাকের মানস গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে৷ ছোটবেলা থেকেই কবিতা ও গল্প লেখার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন আবু ইসহাক৷ ১৯৪০ সালে আবু ইসহাক যখন নবম শ্রেণির ছাত্র তখনই 'অভিশাপ' নামের একটি গল্প তিনি পাঠিয়েছিলেন কলকাতা থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত 'নবযুগ' পত্রিকায়৷ ওই পত্রিকায় ওই বছরের কোনো এক রবিবারে তাঁর গল্পটি ছাপা হয়৷ এটিই আবু ইসহাকের প্রথম প্রকাশিত রচনা৷ সেই গল্পটিই তাঁকে সাহিত্যিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে৷
আবু ইসহাকের সাহিত্যজীবন
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায়ই আবু ইসহাক গল্প ও কবিতা লেখা শুরু করেন৷ তাঁর এসব লেখার বেশকিছু স্কুলের দেয়াল পত্রিকা 'প্রভাতি'তে ছাপা হয়েছে৷ স্কুলের গণ্ডির বাইরে তাঁর প্রথম মুদ্রিত লেখা নবম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে কলকাতা থেকে প্রকাশিত 'নবযুগ' পত্রিকায় ছাপা হয়। ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় 'সওগাত' ও 'আজাদ' পত্রিকায় তাঁর লেখা বেশ কয়েকটি গল্প ছাপা হয়৷ ওই সময় কলেজ বার্ষিকীতে তাঁর অনুবাদ করা একটি কবিতাও ছাপা হয়েছিল৷
দেশের দিশেহারা, নিঃস্ব, অসহায় মানুষদের নিয়ে আবু ইসহাক নারায়ণগঞ্জ থাকাকালে তাঁর প্রথম ও অন্যতম উপন্যাস 'সূর্যদীঘল বাড়ী' রচনার কাজ শুরু করেন৷ সেটা ছিল ১৯৪৪ সাল৷ দীর্ঘ চার বছর পর ১৯৪৮ সালে এটি লেখার কাজ শেষ হয়৷ ১৯৫০ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত এটি ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয় 'নওবাহার' নামক মাসিক পত্রিকায়৷ উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় রচনার সাত বছর পর ১৯৫৫ সালে৷ প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে এবং পরে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে৷
'সূর্যদীঘল বাড়ী'তে এমন অনেক কিছুই আছে যা দেশে ও বিদেশে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভের সময়কে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে এ উপন্যাস৷ 'সূর্যদীঘল বাড়ী' উপন্যাসে আবু ইসহাক অত্যন্ত স্বতঃস্ফুর্তভাবে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন৷ এর ফলে উপন্যাসের কাহিনী ও সামাজিক প্রেক্ষাপট জীবন্ত রূপ লাভ করেছে৷ এছাড়া গ্রামে প্রচলিত গল্প, গান ও ছড়ার ব্যবহারও এক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে৷ এই ভাবেই আবু ইসহাকের 'সূর্যদীঘল বাড়ী' বাংলা উপন্যাসের একটি সফলতার দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে৷
আবু ইসহাকের দ্বিতীয় উপন্যাস 'পদ্মার পলিদ্বীপ'৷ আবু ইসহাক তাঁর এ লেখা সম্পর্কে জানিয়েছেন, 'পদ্মার পলিদ্বীপ' লেখা শুরু করেছিলেন ১৯৬০ সালে এবং শেষ করেন ১৯৮৫ সালে৷ এটি প্রথমে বাংলা একাডেমীর পত্রিকা 'উত্তরাধিকার' এ প্রকাশিত হয় 'মুখরমাটি' নামে৷ পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় এটির নাম রাখা হয় 'পদ্মার পলিদ্বীপ'৷ এ উপন্যাসের কাহিনী ও প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা৷ ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ অর্থাত্ দেশভাগের আগের সময়কে এ উপন্যাসে ধারণ করা হয়েছে৷ এ উপন্যাসের বিশাল প্রেক্ষাপটের মধ্যে গোটা একটা জনপদের মানুষের চিন্তাভাবনা, উপলব্ধি, ভালবাসা, ঘৃণা, তাদের অদম্য উত্সাহ, তাদের পরাজয়- সবই ধারণ করার চেষ্টা করেছেন৷ এর ফলে এ উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে মহাকাব্যের মতো৷ পদ্মার বুকে জেগে উঠা নতুন চরের দখল নিয়ে এ উপন্যাটি রচিত হয়েছে৷ পেশিশক্তির বলে চর দখলের ওপর ভিত্তি করে এ উপন্যাসের কাহিনী গড়ে তোলেন আবু ইসহাক৷
আবু ইসহাকের তৃতীয় ও সর্বশেষ উপন্যাস 'জাল' ১৯৮৮ সালে 'আনন্দপত্র' নামের একটি পত্রিকার ঈদসংখ্যায় প্রথম ছাপা হয়৷ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এর পরের বছর৷ প্রকাশের দিক থেকে তৃতীয় উপন্যাস হলেও এটি লেখা হয় ১৯৫০-এর দশকে৷ এটি লেখার সময় পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আবু ইসহাক কয়েকটি জাল নোটের মামলার তদন্ত করছিলেন৷ শোনা যায়, 'সূর্যদীঘল বাড়ী' প্রকাশের জন্য প্রকাশকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতেই তিনি গোয়েন্দা কাহিনীর আদলে লিখেছিলেন 'জাল'৷ পরে 'সূর্যদীঘল বাড়ী' এতটাই আলোড়ন তোলে যে তিনি নিজের নামের প্রতি অবিচার হতে পারে ভেবে 'জাল'কে প্রকাশ না করে বাক্স বন্দি করে রাখেন দীর্ঘ ৩৪ বছর৷ এর পরে ১৯৮৯ সালে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়৷ আবু ইসহাকের সঙ্গে সাহিত্যের পাঠকের পরিচয় হয় তাঁর গল্পের মাধ্যমে৷ তবে দীর্ঘ সাহিত্য জীবনের তুলনায় তাঁর গল্পের সংখ্যা খুব বেশি নয়৷ প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ মাত্র দুটি- 'হারেম' (১৯৬২) ও 'মহাপতঙ্গ' (১৯৬৩)৷ ২০০১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ 'স্মৃতিবিচিত্রা'কে অনেকেই গল্প সংকলন হিসেবে বিবেচনায় আনেন৷ 'স্মৃতিবিচিত্রা'য় আসলে তিনি নিজের জীবনের স্মৃতিই তুলে ধরেছেন নকশাধর্মী রচনার আদলে৷ এটিকে গল্প সংকলন না বলে স্মৃতিকথা বলাই ভালো৷ বিচিত্র বিষয় অবলম্বনে তিনি গল্প লিখেছেন৷ তাঁর গল্পে ভূমিহীন মানুষ, যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের জীবন, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের জীবনের নানা সমস্যা বিষয়বস্তু হয়েছে৷ বিশ শতকের মানুষের জীবনের আত্মিক, মানবিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট তাঁর গল্পের পটভূমি৷ সাহিত্যের পাঠকের কাছে কিংবদন্তীর মর্যাদায় সমাদৃত আবু ইসহাকের কিছু গল্প৷ এসবের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত 'জোঁক', মানবিক অবক্ষয়ের জায়গা থেকে রচিত 'বর্ণচোর' এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে রচিত 'মহাপতঙ্গ'৷
আবু ইসহাক রচিত একমাত্র নাটক 'জয়ধ্বনি'৷ ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৭ সালের মধ্যে তিনি এটি রচনা করেন৷ বাংলা একাডেমীর কিশোর পত্রিকা 'ধানশালিকের দেশ'-এ এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে৷ নাতি-নাতনিদের আবদারে তিনি এটি রচনা করেন৷ মীজানুর রহমানের 'ত্রৈমাসিক পত্রিকা'-ও পক্ষী সংখ্যায় (১৯৮৮-৮৯) সালে প্রকাশিত 'একটি ময়নার আত্মকাহিনী' নামে তাঁর লেখা গল্প এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ার অভিজ্ঞতার ছাপ পড়েছে এ নাটকে৷ আবু ইসহাকের অপ্রকাশিত রচনার সংখ্যাও খুব বেশি নয়৷ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর কিছু গল্প, একটি ইংরেজি অভিধানের পাণ্ডুলিপি, কিছু প্রবন্ধ এবং 'সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান'-এর অপ্রকাশিত অংশ- এসব মিলিয়ে অপ্রকাশিত রচনাগুলো নিয়ে মাত্র দুয়েক খণ্ডেই রচনাসমগ্র প্রকাশ করা সম্ভব৷
অভিধান প্রণেতা আবু ইসহাক
আবু ইসহাকের প্রথম পরিচয় তিনি একজন কথা সাহিত্যিক৷ দ্বিতীয় পরিচয় তিনি একজন অভিধান প্রণেতা৷ আবু ইসহাকের এই দুই বিশিষ্টতার কোনোটিই কোনো অংশে কম নয়৷ অভিধান প্রণেতা হিসেবে তাঁর গুরুত্ব অনেকখানি৷ আবু ইসহাক 'সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান' প্রণয়ন করে বাংলা ভাষায় নতুন ধরনের এক অভিধানের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন৷ কী আছে নতুন ধরনের এই অভিধানে? এ প্রসঙ্গে আবু ইসহাক খুব সহজ করে বলতে চেয়েছেন তাঁর অভিধানের শুরুতে৷ ধরা যাক, কোনো একটা বিশেষ স্থানের বা বিশেষ সময়ের বিশেষ 'অন্ধকার'-এর বর্ণনা দিতে হবে৷ স্মৃতির কোঠা হাতড়ে হয়তো 'অন্ধকার'-এর কয়েকটা বিশেষণ পাওয়া গেল৷ পাওয়া গেল কালো, গাঢ়, ঘন, ঘুরঘুটি, নিশ্ছ্রিদ্র, ভয়ঙ্কর, সুনিবিড়- ইত্যাকার বিশেষণ৷ ধরা যাক, কোনোটাই অন্ধকারের বর্ণনা দেওয়ার জন্য যথার্থ হচ্ছে না৷ তখন কী হবে? তখন সহায়ক হবে এই অভিধান৷ আবু ইসহাকের এই অভিধানে এক অন্ধকারেরই রয়েছে ১২৭টি বিশেষণ৷ ১৯৯৩ সালের জুনে বাংলা একাডেমী থেকে অভিধানটির প্রথম অংশ (স্বরবর্ণ) প্রকাশিত হয়৷ 'সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান' এর প্রথম অংশ (স্বরবর্ণ) প্রকাশের পর ইত্তেফাক গ্রুপ অব পাবলিকেশন্সের পক্ষ থেকে আবু ইসহাককে মাসিক ১০ হাজার টাকা করে এক বছরের জন্য 'মানিক মিয়া গবেষণা বৃত্তি' প্রদান করা হয়৷ পরে বাংলা একাডেমীর তত্কালীন মহাপরিচালক অধ্যাপক হারুন-উর-রশিদের অনুরোধে আরও ছয় মাসের জন্য মাসিক ৫ হাজার টাকা হারে বৃত্তির মেয়াদ বাড়িয়ে দেন ইত্তেফাক গ্রুপের কর্ণধার ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা)৷
'সমকালীনর বাংলা ভাষার অভিধান' তথা বিশেষণে বিশেষিত শব্দের অভিধানের কাজ করতে গিয়ে শেষ দিকে এসে পুরো পরিবার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আবু ইসহাক৷ অভিধানের জন্য বহু বছর ধরে অসম্ভব নিষ্ঠার সঙ্গে পুরো বাংলাসাহিত্য, বাংলা সংবাদপত্র, সাময়িকপত্র, সাহিত্যপত্র ও শতাধিক অভিধান এবং অন্যান্য রেফারেন্স চষে বেরিয়েছিলেন তিনি৷ আহরণ করেছিলেন দুই লাখেরও বেশি বিশেষিত শব্দ৷ প্রথমে তিনি বেছে নেওয়া বিশেষিত শব্দগুলো ছোট ছোট কার্ডে লিখে গুঁড়ো দুধের খালি কৌটায় রাখতেন ৷ পরে সেগুলো বাছাই করে সুতোয় মালা গেঁথে সাজাতেন৷ এই মালা গাঁথার কাজ ও বিশেষিত শব্দের কার্ড গুছিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করেছেন স্ত্রী, কন্যা, পুত্র ও নাতি-নাতনিরা৷ প্রথম অংশ প্রকাশের আগপর্যন্ত হাতে লিখেই এ অভিধানের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন তিনি৷ পরে বৃত্তির টাকায় একটি কম্পিউটার কিনে কম্পিউটারে পাণ্ডুলিপি গোছানোর কাজ শুরু করেন৷
১৯৯৮ সালে বাংলা একাডেমী 'সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান'-এর ব্যঞ্জনবর্ণ অংশ (ক থেকে ঞ) প্রকাশ করে৷ বিশাল এই অভিধানের বাকি অংশ প্রকাশে উদ্যোগী ছিল বাংলা একাডেমী৷ আবু ইসহাকের আকস্মিক মৃত্যুতে অভিধানের কাজ মাঝপথে থেমে যায় এবং বাকি অংশগুলো প্রকাশে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়৷ আবু ইসহাক তাঁর এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সমাপ্ত করে যেতে পারেননি৷ পুরো অভিধানের পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি হতো বলে ধারণা করেছিলেন আবু ইসহাক৷ তাঁর আকস্মিক মৃত্যু আমাদের এ রকম একটি বিশাল প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করেছে৷
গ্রন্থ
আবু ইসহাকের প্রথম উপন্যাস গ্রন্থাকারে 'সূর্যদীঘল বাড়ী' প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে৷ এর পর ছোটগল্পের সংকলন 'হারেম' প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে৷ পরের বছর প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় ও সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ 'মহাপতঙ্গ'৷ দ্বিতীয় উপন্যাস 'পদ্মার পলিদ্বীপ' গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে৷ তৃতীয় ও শেষ উপন্যাস 'জাল' গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায় ১৯৮৮ সালে৷ একমাত্র নাটক 'জ্বয়ধ্বনি' ২০০১ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী গ্রন্থকারে প্রকাশ করে৷ একই বছর প্রকাশিত হয় স্মৃতিকথা 'স্মৃতিবিচিত্রা'৷ বাংলা ভাষায় অভিনব অভিধান 'সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান' স্বরবর্ণ অংশ বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে৷ পরে ১৯৯৮ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এটির ব্যঞ্জন বর্ণ 'ক' থেকে 'ঞ' পর্যন্ত অংশ৷ এই অভিধানের বাকি অংশের কাজ তিনি শেষ করে যেতে পারেননি৷ এছাড়া 'ডিকশনারি অব ক্যুটেড অ্যান্ড ওয়েডেড ওয়ার্ডস' নামে একই ধরনের একটি ইংরেজি অভিধানের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছিলেন তিনি৷
পুরস্কার ও সম্মাননা
বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য আবু ইসহাক ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৮১ সালে সুন্দরবন সাহিত্য পদক, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক, ১৯৯৭ সালে একুশে পদক, ২০০৪ সালে স্বাধীনতা পদক এবং ২০০৬ সালে নাটক বিভাগে শিশু একাডেমী পদক লাভ করেন তিনি৷ এছাড়াও তিনি বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন৷
মৃত্যু
আবু ইসহাক ২০০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি (৪ ফাল্গুন ১৪০৯ বাংলা) রবিবার রাত ৯টা ১৫ মিনিটে ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে প্রায় ৭৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন৷ ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবসে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে দেশের এই কৃতীসন্তানকে শেষশ্রদ্ধা জানায় সর্বস্তরের মানুষ৷ ঢাকার মীরপুরে বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন আবু ইসহাক৷
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আবু ইসহাকের জীবন ও কর্ম নিয়ে এ লেখার জন্য সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে আবু ইসহাকের রচনাগুলো থেকে৷ এছাড়া নাঈম হাসান সম্পাদিত 'নিরন্তর' (ষষ্ঠবর্ষ, শীত সংকলন, পৌষ ১৪১২) পত্রিকায় প্রকাশিত ড. স্বরোচিষ সরকারের 'আবু ইসহাকের সাহিত্যচর্চা আবু ইসহাকের অভিধান চর্চা' রচনাটি বিশেষ সহায়ক হয়েছে৷ গ্রন্থ হিসেবে সহায়ক হয়েছে বিকাশ মজুমদারের 'আবু ইসহাক: সমাজ বাস্তবতার কথাকার' (বলাকা, চট্টগ্রাম, ফেব্রুয়ারি বইমেলা ২০০৬)৷ সর্বোপরি তথ্য ও অন্যান্য সহযোগিতা দিয়েছেন আবু ইসহাকের পুত্র মুশতাক কামিল৷
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment