আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ Abu Jafar Obaydullah Biography 1934-2001
১৯৩৪ সাল৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য তখন পটে বসছে৷ বিশ্বের দিকে দিকে স্বাধিকার আন্দোলনের দাবীতে ব্রিটিশ শোষণে অতিষ্ট বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সোচ্ছার হয়ে উঠছে৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অস্থির ডামাডোল পেরিয়ে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সমগ্র বিশ্ব তখন এক অস্থির আশংকায় কম্পমান৷ এমনি এক ক্রান্তিলগ্নে ১৯৩৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জেলাশহর বরিশালে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর জন্ম ৷ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ, একজন আমলা, মন্ত্রী এবং সর্বোপরি একজন কবি ৷
If you cannot view the fonts properly please download and Install this file.
বাংলাদেশের উত্তরে গারো পাহাড়ের কোলে গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে ছোট্ট একটি মফস্বল শহর৷ ব্রহ্মপুত্রের পলি বিধৌত এই শহরটির নাম ময়মনসিংহ৷ ময়মনসিংহ শহরকে ডানে রেখে সোজা সমান্তরাল চলে গেছে ব্রহ্মপুত্র৷ তাঁর আগে শহরে ঢোকার পথে একটি বাঁক নিয়েছে নদীটি৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এই শহরের মুন্সেফ ছিলেন আব্দুল জব্বার খান৷ তাঁর দ্বিতীয় ছেলে সেন্টু ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে পড়েন৷ বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রতিদিন বিশাল বিশাল প্রাচীন রেইন্ট্রি গাছের ছায়া আর পাখিদের সুমধুর কলকাকলির ভেতর দিয়ে তিনি স্কুলে যান৷ খুব শান্ত মিষ্টি একটি বালক৷ কোথাও কোন কোলাহল নেই৷ সকালে স্কুল আর বিকেলে বাড়ির ছাদে বসে বসে দূরের গারো পাহাড়টাকে দেখার বাসনায় মাথা উঁচিয়ে এক মনে ধ্যাণ করে বসে থাকেন৷ কোন কোন দিন বিকেলে সূর্যাস্তের আগে নদীর তীর ধরে হাঁটতে যান আপন মনে৷ অনেকটা পথ হেঁটে এসে নদীটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন পশ্চিম দিকে মুখ করে৷ এখানে দাঁড়িয়ে থেকে পশ্চিম দিকের অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায়৷ অনেকটা দূরে সূর্য তখন আপন মনে লালিমা ছড়িয়ে নদীর পেটের ভেতর ডুবে যেতে থাকে৷ বালক মুগ্ধ হয়ে এই দৃশ্য দেখতে থাকে৷ মনে মনে প্রার্থনা করে, এই অপূর্ব দৃশ্য যদি আমি চিরজাগরুক করে রাখতে পারতাম! এই দৃশ্য জাগরুক করার আকাঙ্ক্ষা, পাহাড় দেখার বাসনা বালক সেন্টুকে একদিন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে৷ আর সেদিনের সেই বালকটি হলেন আব্দুল জব্বার খানের দ্বিতীয় ছেলে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ৷ যাঁর ডাক নাম সেন্টু৷
পিতার কর্মস্থল ময়মনসিংহে আবু জাফর ওবায়দুল্লার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু৷ শান্ত স্বভাবের আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লেখাপড়ার প্রতি ছিলেন গভীর আগ্রহী৷ ১৯৪৮ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ভর্তি হন ঢাকা কলেজের কলা বিভাগে৷ ১৯৫০ সালে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে বি এ (অনার্স) কোর্সে ভর্তি হন৷ ১৯৫৩ সালে অনার্স এবং ১৯৫৪ সালে মাস্টার্স কোর্স সমাপ্ত করে তিনি চাকরি জীবনে প্রবেশ করলেও লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন আজীবন৷ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে তিনি আরো শিক্ষা লাভের আশায় পাড়ি জমিয়েছেন সুদূর পাশ্চাত্যে৷ ১৯৫৮ সালে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোক প্রশাসনের উপর ডিপ্লোমা ডিগ্রি নেন৷ ১৯৭৪ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে গবেষণা করার জন্য ফেলোশিপ পান৷ এছাড়াও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হনলুলুর ইস্ট ওয়েস্ট সেন্টারের ফেলো ছিলেন৷
১৯৫৪ থেকে ১৯৯৭ এই ৪৩ বছরের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বহু বৈচিত্রময় পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন৷ ১৯৫৪ সালে তিনি ইংরেজিতে মাস্টার্স করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন৷ ১৯৫৭ সালে অধ্যাপনা পেশা ছেড়ে তিনি যোগ দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে৷ ১৯৮২ সালে তিনি সচিব হিসেবে অবসর নেন এবং মন্ত্রীসভায় যোগ দেন৷ কৃষি ও পানি সম্পদ মন্ত্রী হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করে ১৯৮৪ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে যোগ দেন৷ পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেন বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থায়৷ ১৯৯৭ সালে তিনি একই সংস্থা থেকে পরিচালক হিসেবে অবসর নেন৷ অবসর গ্রহণের পর তিনি ঢাকায় ফিরে একটি বেসরকারী সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবেও বেশ কয়েকদিন দায়িত্ব পালন করেছেন৷
সাতচল্লিশোত্তর বাংলা কবিতায় আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ একটি বিশিষ্ট নাম৷ ৪৭'র দেশ বিভাগের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের কবিতায় ফররুখ আহমেদ, আবুল হোসেন, আহসান হাবীব প্রমুখ যে নতুন কাব্যভূমি তৈরি করেছিলেন সেই কাব্যভূমিতে দাঁড়িয়ে তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর কাব্য পরিভ্রমণ৷ তবে তা কখনোই মসৃণ ছিল না৷ দেশ বিভাগ, নতুন জাতীয়তাবোধের চেতনা, এবং সেই চেতনার অপমৃত্যুর দংশনে ক্ষত বিক্ষত হয়েছে তাঁর কবিহৃদয় এবং সে বেদনার পরিস্ফুটন ঘটে তাঁর কবিতায়৷ ফলে আমরা দেখি কাব্যিক অভিযাত্রার শুরুতেই কবি যে দুঃসহ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন, তাকে কোনভাবে অস্বীকার করতে পারেন নি তিনি বরং গ্রহণ করেছেন সত্য-উপাদান হিসেবে৷ ফলে ১৯৪৭ এর নতুন রাষ্ট্র অর্জনের উচ্ছ্বাস-উন্মাদনার চাইতেও তাঁর কাছে অধিক গুরুত্ব পেল বাংলার দুঃখ কষ্টের কাহিনী৷ উপরিকাঠামোর চাকচিক্য প্রত্যাখ্যাত হল কবির নিকটে৷ অপরিবর্তিত সামাজিক অবয়ব ও বাড়তি সংযোজন পশ্চিম পাকিস্তানী উপনিবেশকে তাঁর মত আরও অনেকেই আন্তরিকতার সঙ্গে চিত্রিত করলেন৷ পঞ্চাশের দশকের সৃজনশীল লেখকদের এবং আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ'র সাহিত্যিক স্বরূপকে তাই বলা চলে বিচ্ছিন্নতা-আক্রান্ত কিন্তু সত্যসন্ধানী৷ বিচ্ছিন্নতা রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও জাতীয়তাবাদের সঙ্গে এবং তাঁর অন্বিষ্ট বিষয়ের আড়ালে নিহিত৷ এ-স্বরূপটিকে কলিন উইলসন তাঁর 'দ্যা আউটসাইডার' গ্রন্থে আধুনিক কবি সাহিত্যিকদের একটি বিশিষ্ট প্রবণতা বলে অভিহিত করেন৷ তাঁর মতে, জীবন-বিরোধী উপাদান বা পরিস্থিতির বিদ্যমানতা সত্যসন্ধানী লেখককে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধে আক্রান্ত করে কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতা জীবনের বিরুদ্ধে নয়৷ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ'র অবস্থান জীবনের ভিত্তিমূলে৷ সে অবস্থানটি যে কখনও টলেনি তার প্রমাণ তাঁর কাব্যগ্রন্থ কমলের চোখ৷
দশক বিচারে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ মূলত পঞ্চাশ দশকের কবি৷ পঞ্চাশের দশকেই তাঁর কবি হিসেবে আবির্ভাব এবং এই দশকেই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়৷ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাতনরী হার প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে৷ সওগাত প্রেস থেকে বইটি প্রকাশ করে দিয়েছিলেন কবি হাসান হাফিজুর রহমান৷ প্রথম গ্রন্থেই তিনি জানান দিয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব কন্ঠস্বরের৷ তাঁর লেখালেখির পেছনে হাসান হাফিজুর রহমানের প্রেরণা ছিল অসামান্য৷ হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রথম সংকলনে প্রকাশিত তাঁর কবিতা কোন এক মাকে কবি হিসাবে তাঁর সোচ্চার আবির্ভাব ঘোষনা করে৷ তাঁর ঐ কবিতা ভাষা শহীদ দিবসে দেশের প্রতিটি শহীদ মিনার থেকে উচ্চারিত হয়৷ কবিতার জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন ছড়া ও গাঁথা কবিতার এক চিরায়ত লোকজ আঙ্গিক৷ আর এই আঙ্গিকের কারণেই প্রথম থেকেই তিনি তাঁর পঞ্চাশ দশকের অন্য সহযাত্রীদের থেকে ছিলেন আলাদা এবং স্বতন্ত্র৷ আর সে স্বাতন্ত্র্য তিনি তৈরী করেছিলেন এক ধরণের বাঙালিয়ানা আত্মস্থ করার ভেতর দিয়ে৷ ফলে আমরা দেখি পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে তাঁর সহযাত্রী অন্য কবিরা যখন ত্রিশের জীবনানন্দ দাশ কিংবা বুদ্ধদেব বসু'র কবিতায় প্রবলভাবে আচ্ছন্ন তখন তিনি ছড়া ও গাথা কবিতার ভেতর দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন৷ কারণ তিনি তাঁর মনের মধ্যে বাঙালির শাশ্বত স্বরধ্বণি শুনতে পেয়েছিলেন৷ আর তাই ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের ভেতর দিয়ে হাজার বছরের লোকজ ছড়ার ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন- কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে/ আগুন লেগেছে,/ পলাশবনে লাল পরীরা/ নাইতে নেমেছে৷/ কে দেখেছে? কে দেখেছে?/ কন্যে দেখেছে,/ নীল দীঘিতে স্বপ্ন হয়ে/ ভেসে উঠেছে৷/ কে বলেছে? কে বলেছে?/ শালুক বলেছে,/ এলো খোঁপা বাঁধতে গিয়ে/ কন্যে কেঁদেছে৷/ কে শুনেছে? কে শুনেছে?/ কেউতো শুনেছে,/ সোনার কাঁকন খুঁজতে মেয়ে/ জলে ডুবেছে৷ ( কুঁচবরণ কন্যা/ সাতনরী হার)৷
যদিও তিনি লোকজ ধারায় নিজেকে প্রকাশ করেছেন তথাপি তাঁর কবিতায় আধুনিকতা এবং আধুনিক কবিতার আঙ্গিকের কমতি ছিল না কোন ক্রমেই৷ কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সম্পর্কে তাঁর উত্তরসূরী এক কবি ইকবাল আজিজ এক প্রবন্ধে বলেছেন- "১৯৫৫ সালে প্রকাশিত সাতনরি হার কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটি (কুঁচবরণ কন্যে) পড়েই বোঝা যায়, লোকজ ছড়ার ঢঙে তিনি যেন কাহিনী বলতে চেয়েছেন সেই শুরু থেকে, আর পুঁথি কবিতার মধ্য দিয়ে কাহিনী বলে যাওয়ার প্রবৃত্তি বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক আচরণ ও অভ্যাসের সঙ্গে বিজড়িত অথচ তিনি আধুনিক কবি; কবিতার দর্শন, আঙ্গিক ও চেতনার দিক দিয়ে জসীম উদ্দীন কিংবা বন্দে আলী মিয়ার কবিতা থেকে তিনি সম্পূর্ণ আলাদা অবস্থানে৷ এখানেই তাঁর প্রতিভার মৌলিকত্ব; তিনি লোকজ ছড়া ও গাথা-কবিতার ভাষায় কথা বলেছেন কিন্তু তাঁর চেতনা সুস্পষ্টভাবে একজন আধুনিক মানুষের মননকে প্রতিনিধিত্ব করেছে৷ এক্ষেত্রে ওবায়দুল্লাহকে সমকালীন আইরিশ কবি সিমাস হিনি কিংবা তাঁর বহু পূর্বের দুই মার্কিন কবি হুইটম্যান ও রবার্ট ফ্রস্টের সঙ্গে তুলনা করা যায়৷ এই কবিরা যেমন আধুনিক হয়েও তাঁদের লোকজ অভিজ্ঞানকে ব্যবহার করেছেন অতিশয় নিপুণতার সঙ্গে; তেমনি ওবায়দুল্লাহও লোকজ ছড়া ও গাথা-কবিতার ঢঙে কবিতা নির্মাণ করেছেন৷"
১৯৫৫ সালে প্রথম কাব্য প্রকাশ হলেও তাঁর দ্বিতীয় কাব্য প্রকাশ হয় দীর্ঘ বিরতিতে ১৯৭০ সালে৷ তাঁর দ্বিতীয় কাব্য কখনো রং কখনো সুর৷ এরপর ১৯৭৪ সালে বেরিয়েছে কমলের চোখ৷ ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর সর্বাধিক পাঠকপ্রিয় কবিতার বই আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি৷ মূলত আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিজীবনের টার্নিং পয়েন্টও এই কবিতাটি৷ আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি কাব্যের ভেতর দিয়ে তিনি তাঁর কাব্যভাবনা ও কাব্যদেবী সম্পর্কে ঋজু ভঙ্গিতে যে সরল স্বীকারোক্তি করেছেন, তা প্রকাশ করেছেন অপরূপ মায়াবী এক ঐন্দ্রজালিক ভাষাময়তায়- আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি/ আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি /তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিলো/ তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিলো৷/ তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন / অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন / তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন৷ /জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা / কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা৷
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ মেঘমন্দ্র স্বরে এই কবিতায় যে অমোঘ সত্যবানী এবং মুক্তির আশা ব্যক্ত করেছিলেন তাতে করে এদেশের অনেক পাঠকই যেন দীর্ঘদিন পর কবিতায় কোন মহান মুক্তিদাতার কন্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিল৷ ফলে পাঠক সমাজে কবিতাটি বিপুলভাবে দাগ কেটেছিলে৷ এরপর এক এক করে বেরিয়েছে সহিষ্ণু প্রতীক্ষা, বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা মৃত্যুর পর বেরিয়েছে মসৃণ কৃষ্ণ গোলাপ৷ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর গ্রন্থ সংখ্যা বারোর অধিক৷
বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ছিল তাত্পর্যপূর্ণ অবদান৷ ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রসমাজের আন্দোলন যখন চরম আকার ধারণ করে তখন শাসক গোষ্ঠী ছাত্রদের মিছিলে ১৪৪ ধারা জারি করে৷ কিন্তু ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশ সেই মিছিলে গুলি বর্ষণ করে এবং শহীদ হয় রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত প্রমুখ৷ ১৯৫২ সালে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র৷ '৫২ ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে, মিছিলে, মিটিঙে তাঁর উপস্থিতি ছিল সরব৷ '৫২-র সেই মিছিল, পুলিশের গুলিবর্ষণ, শহীদ হওয়া ছাত্রদের লাশ তাঁর মনে গভীর বেদনার সৃষ্টি করেছিল৷ সেই বেদনা থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নিয়েছিল তাঁর বিখ্যাত কবিতাকোন এক মাকে৷ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাহিত্য আন্দোলনেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন তিনি৷ ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের প্রগতিশীল কবিদের নিয়ে গঠন করেছিলেনপদাবলী নামের একটি সাহিত্য সংগঠন৷পদাবলী বাংলাদেশের সাহিত্য সংগঠনের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা৷ দীর্ঘদিন ধরে কবিতার অনেকগুলো ধারাবাহিক সেশনের আয়োজন করেছিল এইপদাবলী৷ শুধু তাই নয় তাঁরা একটি নতুনত্বও এনেছিলেন তাঁদের আয়োজনে৷ দর্শনার্থী এবং শ্রোতাদের নির্দিষ্ট প্রবেশমূল্য পরিশোধ করে কবিতা ও কবিতার আলোচনা শুনতে হত৷ বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এটি ছিল একটি বিরল ঘটনা৷
বাবা আব্দুল জব্বার খান ছিলেন বিচারক৷ হাইকোর্টের জজ হিসাবে তিনি অবসর নেন৷ পরবর্তীতে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার হন ৷ মা সালেহা খাতুন ছিলেন গৃহিনী৷ অল্প বয়সে তাঁর মা মারা গেলে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন৷ নতুন মা নিজেকে সত্ মা হিসেবে কখনও বুঝতে দেননি তাঁদের৷ ফলে সহোদর ভাই বোন এবং সত্ ভাই বোনের কোন ভেদরেখাও ছিলনা তাঁদের৷ আট ভাই পাঁচ বোনের সকলেই ছিলেন মেধাবি, একনিষ্ট এবং কর্মঠ৷ ফলে তাঁরা আজ সকলেই নিজ নামে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত৷ তাঁর ভাইদের মাঝে রয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাপ্তাহিকহলিডে সম্পাদক মরহুম এনায়েত উল্লাহ খান, বিশিষ্ট সাংবাদিক সাদেক খান, রয়েছেন বাংলাদেশের বাম রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন৷ ছোট ভাই মাহীদুল্লাহ খান বাদল মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক৷ তিনি আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন৷ বর্তমানে ব্যবসায়ি৷ তাঁর এক বোন বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের সাহসী কন্ঠস্বর সাবেক মন্ত্রী বেগম সেলিমা রহমান৷ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বিয়ে করেছিলেন ১৯৫৮ সালে৷ তাঁর স্ত্রী মাহজাবীন খান৷ এই দম্পতির দুই ছেলে এক মেয়ে৷
ব্রিটিশযুগে জন্ম ও বেড়ে ওঠা, পাকিস্তান যুগে যৌবন এবং বাংলাদেশে দেখেছেন নিজের পরিণতি, সফল পরিসমাপ্তি৷ এই ত্রিকালদর্শী মহতী পুরুষ, মহান কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রায় এক বত্সর অসুস্থ থাকার পর ২০০১ সালের ১৯ মার্চ ৬৭ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন৷
সংক্ষিপ্ত পরিচিত
নাম: আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
জন্ম : ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৪, বাহেরচর, বাবুগঞ্জ, বরিশাল৷
মৃতু্য : ১৯ মার্চ ২০০১, ঢাকা৷
বাবা : আব্দুল জব্বার খান
মা : সালেহা খাতুন
স্ত্রী : মাহজাবীন খান
পেশা : সাবেক সচিব, সাবেক মন্ত্রী৷
শিক্ষা : মাধ্যমিক- ময়মনসিংহ জিলা স্কুল,১৯৪৮৷ উচ্চ মাধ্যমিক- ঢাকা কলেজ, ১৯৫০৷ স্নাতক (সম্মান)- ইংরেজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৩৷ স্নাতকোত্তর- ইংরেজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়. ১৯৫৪৷
প্রকাশিত গ্রন্থ : কবিতা : সাতনরী হার (১৯৫৫), কখনো রং কখনো সুর (১৯৭০), কমলের চোখ (১৯৭৪), আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি (১৯৮১), সহিষ্ণু প্রতীক্ষা (১৯৮২), প্রেমের কবিতা (১৯৮২), বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা (১৯৮৩), আমার সময় (১৯৮৭), নির্বাচিত কবিতা (১৯৯১), আমার সকল কথা (১৯৯৩), মসৃণ কৃষ্ণ গোলাপ প্রভৃতি৷
পুরস্কার : বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৯), একুশে পদক (১৯৮৫)৷
তথ্যসূত্র: উকিপিডিয়া,ইন্টারনেট, বাংলা একাডেমী লেখক অভিধান, রাশেদ খান মেনন ও কবি মুশারাফ করিমের স্মৃতি থেকে নেওয়া৷
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment