শামসুর রাহমান Shamsur Rahman Biography 1929-2006
অনিদ্রার বিভীষিকায় তুমি এলে
-অনন্তের একবিন্দু আলো
কোনো একজনের জন্যে/প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে
If you cannot view the fonts properly please download and Install this file.
বাংলাদেশের সমান বয়সী কবি
সাহিত্যের ইতিহাস সামষ্টিক প্রয়াসের হাত ধরে অগ্রসর হলেও, সব কালেই দেখা যায়, ব্যক্তিবিশেষ উত্তুঙ্গ উচ্চতা নিয়ে আর সবাইকে ছাড়িয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। বহুদূর কোনো বনের অবস্থান যেমন সর্বোচ্চ মহীরুহের নিশানা থেকে আন্দাজ করা যায়, কখনো কখনো সাহিত্যে ব্যক্তির ভূমিকাও তেমনই।
ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের কবিতায় শামসুর রাহমানের অবস্থান উচ্চতম মহীরুহের মতো। বাংলাদেশের কবিতার শ্যামল নিসর্গ ও সামগ্রিক সর্বনাশের মধ্যে শামসুর রাহমান নিঃসন্দেহে কবি-মহীরুহ। শামসুর রাহমান বিশ শতকের তিরিশ পরবর্তী বাংলা কবিতার গুটিকয় অন্যতম কবির একজন। আবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিনি শুধু অন্যতমই নন, বরং অনন্য, প্রধান কবি। কবিতার গুণগত উত্কর্ষ, চর্চার দিগন্ত, উত্পাদনের অজস্রতা, বর্ণবিভার বহুমাত্রিকতা ও বিষয়ের বহুগামিতায়ও তাঁর কবিতা দ্বিতীয়-রহিত। কবিতার সংখ্যার দিক থেকে বহুপ্রজ রবীন্দ্রনাথের সাথে তুলনীয় তিনি। কবি শামসুর রাহমানের ঋদ্ধি ও সিদ্ধি আজ সহস্র স্বীকৃতির হাততালিতে মুখর।
ভ্রূণাবস্থা থেকে সুবিকশিত বাংলাদেশের সমান্তরালে বয়ে এসেছে শামসুর রাহমানের কবিতা চর্চা। এদিক থেকে তিনি জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের সমান বয়সী কবি-সহোদর। ১ঌ২ঌ সালের ২৩ অক্টোবর বুধবার সকালে ঢাকা শহরের মাহুতটুলির এক সরু গলির ভিতর নানার কোঠাবাড়িতে শামসুর রাহমানের জন্ম। নাম থেকে পৈত্রিক উপাধি 'চৌধুরী'�বাদ দিয়েছেন। তাঁর ডাক নাম বাচ্চু। ৪৬ নং মাহুতটুলির সেই কোঠাবাড়ি কোনও রাজসিক ভবন নয়, একটি মাটির ঘর। কোঠাবাড়িই বলে দিচ্ছে, সোনার চামচ মুখে জণ্ম নয় শামসুর রাহমানের। কিন্তু তারপরও নিজের প্রতিভা এবং ভালবাসা দিয়ে তিনি সারা বাংলাদেশের কাব্যপ্রেমী মানুষদের এক গ্রন্থিতে বাঁধতে পেরেছিলেন। এই মহান কবি ২০০৬ সালের ১৭ই আগষ্ট আমাদের সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে পরলোকে চলে গেছেন। বাংলা সাহিত্য এই চির তরুন কবির কাছে চির কৃতজ্ঞ। তাঁর অভাব কখনোই পূরণ হবার নয়।
প্রথম মহাযুদ্ধের বারুদের গন্ধ মিলিয়ে গেছে কবির জণ্মের ১১ বছর আগে। তারও আগে, কবির জণ্মের প্রায় ১৮ বছর আগে, ১ঌ০৫ সালের ১৬ অক্টোবরে যে বঙ্গভঙ্গ খুশি করেছিল ঢাকা কেন্দ্রিক শিক্ষিত পেশাজীবী বাঙালি মুসলমানকে, তাও রহিত হয়ে গেছে ১ঌ১১ সালে। তবে ১ঌ১১ সালেই রংপুরে মুসলিম প্রাদেশিক শিক্ষা সম্মেলনে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ভাষার প্রশ্নে বলে বসেছেন, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। তাঁর এ বক্তব্য যে মুখ ফস্কে আকস্মিক বলে ফেলা নয়, তার প্রমাণ পাওয়া গেল আরও পরে। প্রমাণ পাওয়া গেল যখন তিনি ১ঌ২১ সালে মাতৃভাষা বাংলার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের কাছে লিখিত প্রস্তাব রাখেন তখন। ১ঌ৩৭ সালের এপ্রিলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে দৈনিক আজাদে দীর্ঘ সম্পাদকীয় লেখেন মাওলানা আকরাম খাঁ।
বাঙালি মুসলমান আগে বাঙালি, না আগে মুসলমান- এ ব্যাপারে চেতনাগত বিভ্রান্তির অবসান আজও হয়নি। এ বিভ্রান্তির জায়গা থেকেই বাঙালি মুসলমান হয়ে পাকিস্তান যেমন চাচ্ছিল তেমনই বাঙালি হয়ে চাচ্ছিল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা। তাদের এ বিভ্রান্তির ধুম্রজাল থেকে যে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়, তাতে অনেক মানুষকেই পুড়তে হয়েছে। দাঙ্গার মতো রক্তাক্ত সংঘর্ষের ভিতর দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে। কিন্তু ভাষার প্রশ্নে ১ঌ১১ থেকে যে দাবি উঠে আসছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তা আরও তীব্র রূপ পেতে থাকল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন মাসের মাথায় ১ঌ৪৭ সালের ডিসেম্বরে করাচি শিক্ষা সম্মেলনে রাষ্ট্রভাষা উর্দুর ব্যাপারে প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১ঌ৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাভাষাকে গণপরিষদে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব রাখেন। এরপর থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন ক্রমশ উত্তাল হয়ে ১ঌ৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পরিণতি লাভ করে। পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের দীর্ঘকালের একটি বিভ্রান্তির অবসান ঘটায় একুশে ফেব্রুয়ারি। লাহোর প্রস্তাব বা দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে �৪৭ সালের বিভাজনই যে চূড়ান্ত ফয়সালা নয়, বাঙালির চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষা যে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র তারই বহিঃপ্রকাশ ১ঌ৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেই আকাঙ্খার চূড়ান্ত বাস্তবায়ন ১ঌ৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। শামসুর রাহমানকে আমরা বাংলাদেশের সমান বয়সী সহোদর বা বাংলাদেশের প্রধান কবি বলতে চাই বলেই ইতিহাসের এই ভূমিকা অনিবার্য।
যেখানে সূর্যের তলে আকাঙ্ক্ষিত সুন্দরের গাঁথা
নিসর্গে মধুর মতো, ফুলের পাঁপড়ির মতো ঝরে
অথবা যেখানে গাঢ় চন্দ্রবোড়া সঙ্গিনীর শাখায় আকুল
ঋতুর মতো রণে পরাক্রান্ত, সেখানে আমার অভিলাষ অভিসারী
[ সুন্দরের গাঁথা /প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে]
নাগরিক অভিধার কিংবদন্তী ও কবিতার স্বভূমি
শামসুর রাহমানের জন্য বাংলা কবিতার আধুনিকতা সংক্রান্ত আরো একটি ভূমিকা আমাদের টানতে হচ্ছে। টানতে হচ্ছে এ কারণে যে শামসুর রাহমান বাংলাদেশের আধুনিক বাংলা কবিতার এবং বাঙালি মুসলমানের মধ্যে প্রথম সফল আধুনিক কবি। আধুনিক বাংলা কবিতার যাত্রা শুরু হয় বিহারীলাল চক্রবর্তীর কলমের রেখা ধরে। কিন্তু বিহারীলাল বাংলা কবিতাকে পুরোমাত্রায় আধুনিক করে তুলতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের ভোরের পাখি� অভিধায় তাঁকে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়তে হয়েছে পশ্চিমি রোমান্টিসিজমের সাথে পরিচয়ের অভাবে। বাংলা কবিতার সেই অপরিচয়ের দৈন্য ঘুচিয়ে দিয়েছেন মাইকেল মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা কবিতাকে বিশ্ব কবিতার প্রাণ প্রবাহের মধ্যে মিশিয়ে দিলেন তাঁরা।
পরবর্তীতে বাংলা কবিতায় সর্বভুক আধুনিকতা এনে দিলেন তিরিশের কবিরা। তিরিশের বুদ্ধদেব বসু, জীবনান্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখরা শুরু করেছিলেন রবীন্দ্র অনুকরণ দিয়েই। কিন্তু অচিরেই তাঁরা উপলব্ধি করতে পারলেন: মহাপ্রতিভার অনুকরণ করাই কবিতাজগতের একমাত্র রীতি নয়, ঋণও নেওয়া সম্ভব এ জগতে। ভারতের, বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিতা থেকে তো অবশ্যই সারাবিশ্বের কবিতা থেকেই ঋণ নিলেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথ থেকে ঋণ নেওয়ার ধরন পাল্টালেন৷ রবীন্দ্রনাথ যে-সমস্ত সদগুণের আঁধার, তাঁদের সন্ধানের বিষয় ছিল সে-সমস্তের বিপরীত বস্তু। তাদের এ প্রয়াসের মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতা আধুনিক দুনিয়ার সাথে তাল মেলানোর মতো স্বাভাবিক ক্ষমতা অর্জন করল।
চল্লিশের দশকে, যখন আধুনিক বাংলা কবিতার প্রতিষ্ঠা পাকা হয়ে গেছে তখন নিখিল বাংলা কবিতার চেতনা থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার মতো এক নতুন চেতনার উণ্মেষ ঘটে যায় পূর্ববঙ্গে। পূর্ববঙ্গ কেন্দ্রিক বাঙালি মুসলমানরা, আলাদা কাব্যভূমি গড়ে তোলার প্রয়াস শুরু করেন। এ প্রয়াসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, সিকান্দার আবু জাফর, আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, গোলাম কুদ্দুস, মতিউল ইসলাম, আজিজুর রহমান, তালিম হোসেন প্রমুখ। এদের মধ্যে বিশেষভাবে নজর কাড়েন প্রথম চার-পাঁচজন। শামসুর রাহমানের পূর্বসূরি হওয়া সত্ত্বেও এদের কাছ থেকে শামসুর রাহমানের ঋণ নেওয়ার বা এদের টপকে যাওয়ার কিছু ছিল না। শামসুর রাহমানের যা কিছু বাঁধা পড়েছিল তিরিশের কবিদের কাছেই। এ থেকেই বোঝা যায়, বাঙালি মুসলমান বাংলা কবিতার আধুনিকতা চল্লিশে পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি।
১ঌ৬০ সালে প্রকাশিত হয় কবি শামসুর রাহমানের "প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে"৷ "চল্লিশের দশক থেকে আধুনিকতা ও আধুনিক কবিতার সাথে যুক্ত হওয়ার জন্যে স্খলন-পতন-ভরা যে-শ্রমসাধনা করে আসছিলেন বাঙালি মুসলমান কবিমণ্ডলি, তা ব্যাপক সাফল্য লাভ করে "প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে" তে এসে। তিরিশের কবিতা স্রোতের সাথে "প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে"�র সাহায্যে বাংলাদেশকে দৃঢ় সংযুক্ত করেন শামসুর রাহমান। শামসুর রাহমান-পূর্ব কোনো বাংলাদেশীর কবিতায় আধুনিক জীবন- ও কাব্য- চেতনার এমন ব্যাপক-প্রবল-গভীর প্রকাশ গোচরে আসে না।"
আধুনিক কবিতা আধুনিক সমাজ ও মানুষের সমান্তরাল হবে সেই তো স্বাভাবিক। নাগরিক জীবন ও যন্ত্রণার সফল রূপকার শামসুর রাহমানের জন্য তাই অনিবার্য অভিধা নাগরিক কবি। ঢাকা শহরের অলিগলি ও অন্ধিসন্ধির সাথে সাতপাকে বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন শামসুর রাহমান। নাগরিক বিষ পান করেই তিনি হয়ে উঠেছেন নীলকণ্ঠ। আধুনিক কবিতার যে মর্মচেতনা তা নাগরিক মানসের ক্লেদ ও কালিমার প্রতিভাষ। এসব কবিতায় গেঁথে নেওয়ার ক্ষেত্রে সফল হওয়ার পেছনে তাঁর জণ্ম ও স্বভাবগত নাগরিকতা কার্যকর ভূমিকা রাখলেও রেখে থাকতে পারে। জীবনের শুরু হয়েছিল পুরনো ঢাকার মাহুতটুলিতে। মধ্য জীবনে বেগম বাজার, আশেক লেন, ইস্কাটন ঘুরে শেষ আশ্রয় গেড়েছেন শ্যামলীতে। ঢাকার নাড়ির সাথে নাড়ি বাঁধা এ কবির কবিতায় ঢাকা যেভাবে ঘুরে ফিরে আসে তাতে এই নগরীর চড়াই-উত্ড়াই ও উত্থান-বিকাশের যাবতীয় নিয়ে ঢাকার একটি পূর্ণাঙ্গ চরিত্রই তাঁর কবিতার মাধ্যমে উপলব্ধি সম্ভব। এজন্যে খুব একটা প্রচেষ্টা চালাতে হবে না পাঠককে।
নাগরিক অভিধা�র কিংবদন্তি তাঁর তাজ হয়ে গেলেও, গ্রাম অপরিচিত নয় কবি শামসুর রাহমানের। পৈত্রিক ভিটা বর্তমান নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার মেঘনা তীরবর্তী গ্রাম পাড়াতলীতে। পাড়াতলীর মুন্সিবাড়ি, গাছপালা, পুকুর, মাঠঘাট কবির সুপরিচিত। পিতা মোখলেসুর রাহমান চৌধুরী ও অকালপ্রয়াত মানসিক প্রতিবন্ধী পুত্র মতিন চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে সেই গ্রামে। পাড়াতলী কবিকে বেঁধে রেখেছে দু�দিক থেকে দু� প্রজণ্মের মায়ার বন্ধনে।
কী যেন পাখির মতো গেল উড়ে মাথার ওপর-
আমি ওকে ছেলেবেলা ভেবে অন্তরঙ্গ স্বরে কাছে
ডাকলাম হাত নেড়ে; অজস্র টিয়ের কলরবে
হারালো আমার কণ্ঠস্বর।
[একটি প্রস্থান, তার অনুষঙ্গ/নিরালোকে দিব্যরথ]
শৈশবের মনে শিল্পের আলোক
সাহিত্যচর্চার বালাই নেই এমন এক পরিবারে বেড়ে উঠেছেন কবি শামসুর রাহমান। পরিবারের কারো সঙ্গীত, চিত্রকলা ও সাহিত্য সম্পর্কে তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। তবে পুরনো ঢাকার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ কাওয়ালি ও মেরাসিনের গানের সাথে পরিচয় হয়েছিল অতি শৈশবেই। সম্পন্ন পরিবারের লোকজন উপলক্ষ পেলেই কাওয়ালির আয়োজন করতো। প্রসূতির ছটিঘরে চল্লিশ দিন অতিবাহিত হওয়া উপলক্ষ্যে মেরাসিনের গানের আয়োজন করা হতো।
পারিবারিক সংগ্রহে সাহিত্য বলতে ছিল 'আনোয়ারা' ও 'বিষাদসিন্ধু' গ্রন্থ। আনোয়ারা পড়ার সুযোগ মেলেনি কবির, তবে বিষাদসিন্ধু পড়েছেন এবং নানিকেও পড়ে শুনিয়েছেন। এছাড়া হাতের কাছে পেয়েছিলেন শিশুদের উপযোগী যোগীন্দ্রনাথ সরকারের 'হাসিখুশি'৷ চমত্কার লেখা ও ছবিতে সমৃদ্ধ ছিল বইটি। পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যান্য বই নেড়েচেড়ে দেখা ছাড়া আর কোনো আগ্রহ ছিল না শামসুর রাহমানের। তার চেয়ে মাহুতটুলির কোঠাবাড়ির ছাদ দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিদিনের ঢাকার কর্মচাঞ্চল্যের বিচিত্র বিষয়-আশয় দেখায় তাঁর মন টানতো বেশি।
পুরনো ঢাকার মাহুতটুলিতে তিরিশ ও চল্লিশের দশকে দালানকোঠা ও যন্ত্রচালিত গাড়ি ছিল না বললেই চলে। মাটির ঘর, ঘোড়ার গাড়ি, সহিস, বিভিন্ন দোকান, আরমানিটোলা স্কুলের পেছনের শিউলিতলা, জণ্মাষ্টমীর উত্সব, মহরমের মিছিল ও তাজিয়া, দেবদেবীর ছবি, কাননবালার ছবি, বাবুবাজারের পতিতালয় এসব সারাজীবনের স্মৃতি জুড়ে ডানা মেলে ছিল। ঢাকায় তখনও বিদ্যত্ ছিল না। মহল্লার মোড়ে ও গলিতে সন্ধ্যায় বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে যেত যে বাতিঅলা। পরিণত বয়সে 'শৈশবের বাতিঅলা আমাকে' (বিধ্বস্ত নীলিমা গ্রন্থ) কবিতায় সেই বাতিঅলা হয়ে উঠেছে অনুষঙ্গ।
বাবার সাথে শৈশবে নরসিংদীর পাড়াতলী যাওয়ার সুবাদে গ্রাম, মানুষ, গাছপালা, পাখি, প্রজাপতি, ফড়িং, মেঘনা নদী, বজরা নৌকা ইত্যাদির সাথে সখ্য গড়ে ওঠে। বড়শিতে মাছ ধরার বিদ্যাও রপ্ত করেছিলেন তিনি। পাড়াতলী থেকেই প্রাণ ভরে নিয়েছিলেন পল্লী প্রকৃতির স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ ও বৈচিত্র। পরিবারের কেউ গায়ক, চিত্রকর ও সাহিত্যিক না হলেও, শৈশবেই জলজ্যান্ত এক কবির দেখা পেয়েছিলেন তিনি। সেই কবি বাবার বন্ধু আব্দুল মজিদ সাহিত্যরত্ন। সেই কবি ও কয়েকটি গ্রন্থের প্রণেতা খুব পান খেতেন। বাবার সাথে আড্ডা দিতে আসতেন আব্দুল মজিদ সাহিত্যরত্ন।
টিফিনের পয়সা জমিয়ে সস্তার দোকান থেকে কারবালার কাহিনীর বিখ্যাত ঘোড়া দুলদুলের একটা ছবিও কিনেছিলেন শামসুর রাহমান। শৈশবে তাঁর দেখা প্রথম চিত্রকর বাবুবাজারের নঈম মিঞা। ছেলেবেলায় স্কুলে যাওয়ার পথে নঈম মিঞার দোকানের সামনে দাঁড়াতেন শামসুর রাহমান। তুলি দিয় কাঁচের ওপর ছবি আঁকতেন নঈম মিঞা। সেগুলো বিক্রি করতেন তিনি। নঈম মিঞার কাছে ছবি আঁকার পাঠ শুরু করেছিলেন কবি। একদিন নঈম মিয়া শামসুর রাহমানকে ধমকে বিদায় করে দেন। জীবনের প্রথম শিল্পের ওস্তাদ নঈম মিঞা চাননি শিল্পের নেশায় এই শিশুর জীবনও তার মতো খুকখুক কাশির ও ধুকধুকে কষ্টের হয়ে উঠুক৷ নঈম মিঞার মতো পরবর্তী জীবনে শামসুর রাহমানের বাবাও চাননি তাঁর ছেলে কবি হোক। কবিতা লিখলে জীবনে বিত্তবৈভবে সফল হওয়া যায় না, তাই অভিভাবকদের কাউকেই এ ব্যাপারটি উত্সাহিত করে না।
শৈশবে কবি তাঁর শিল্পের ক্ষুধা মিটিয়েছেন সস্তা হিন্দি সিনেমা দেখে। বাবা কিছুদিন সিনেমা হলের মালিকানার অংশীদারিত্বের ব্যবসায় ছিলেন। তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জের ডায়মন্ড ও ঢাকা তাজমহল সিনেমা হলের অংশীদার। বৈমাত্রেয় মেজো ভাই আমিনুর রাহমান চৌধুরী (সোলেমান) ছিলেন তাজমহল সিনেমা হলের অপারেটর। ঘরের মায়া তাঁর ছিলনা৷ উড়নচণ্ডী সেই ভাই নৌবাহিনীর চাকরি নিয়ে সমুদ্রে ও বিদেশ-বিভূঁইয়ে জীবন কাটিয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথের 'চয়নিকা' থেকে 'ভারততীর্থ' কবিতাটি আপনমনেই নিজের মতো আবৃত্তি করতেন কবির মেজো ভাই। আবৃত্তিকারের গভীর আন্তরিকতার কারণে কবির শৈশব মনে গেঁথে গিয়েছিল সেই কবিতা। তখনও রবীন্দ্রনাথের মহিমা কবির অজানা।
বড় ভাই খলিলুর রাহমানের স্ত্রী জাহানারা বেগম ছিলেন নবাব বাড়ির মেয়ে। উর্দু সাহিত্যে বিস্তর পড়াশোনা ছিল কবির বড় ভাবির। বড় ভাবি পাঠ করে শুনিয়ে ছিলেন বেশকিছু উর্দু গল্প ও কবিতা এবং মির্জা গালিবের গজল। বিধবা ফুফুর ছেলে ইয়াকুব আলী খান থাকতেন কবির পরিবারের সাথেই। ইয়াকুব আলীর রূপকথা বলার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। নিজস্ব ভিয়েন দিয়ে রূপকথাকে আরো রূপময় করে তুলতেন ইয়াকুব আলী। কবির পরবর্তী জীবনে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানকে নিয়ে লেখা প্রতীকী কবিতা 'হাতির শুঁড়া'-এ (রৌদ্র করোটিতে) ইয়াকুব আলীর রূপকথার ঋণ আছে।
কবির মনতো আজণ্ম সংবেদনশীল। অনুভব ভারাতুর এক স্পর্শকাতরতা নিয়েই জণ্ম হয় কবির। আর পাঁচজনের মনে যা দাগ কাটে না, তাই কেটে বসে যায় কবির মনে। শৈশবের স্মৃতি অধিকাংশ মানুষের মনেই মায়াবী আকাশ হয়ে থেকে যায়। সাহিত্যও একার্থে কবি-লেখকের মায়াবী শৈশবের গান। শামসুর রাহমানের শৈশবের মনের গঠন ধরা পড়ে এসব স্মৃতিতে। ধরা পড়ে একজন আপাদমস্তক কবির হয়ে উঠার নেপথ্যভূমির পরিচয়। সচেতনভাবে শৈশবে কবি হতে চাননি শামসুর রাহমান। তেমনভাবে শৈশবে কবি হওয়ার বাসনা ক'জনই বা করে। তাছাড়া, শৈশবের বাসনা তো ছেলের হাতের মোয়া। আশৈশব কবি হওয়ার বাসনা না থাকলেও, পারিবারিক বলয়ে কবিতার আবহ না থাকলেও কবি বা শিল্পী মনের মতোই একটি গ্রাহী মন ছিল তাঁর। মন যে ছিল, সেই পরিচয় মেলে 'কালের ধুলোয় লেখা', 'স্মৃতির শহর' এবং বিভিন্ন শিশুতোষ গ্রন্থে। এছাড়া তাঁর সারাজীবনের কবিতায়ও সে মনের পরিচয় পরিকীর্ণ হয়ে আছে।
কবির শৈশবে সামান্য জিনিসের প্রতি অসামান্য আগ্রহ এবং স্মরণে সেসবের সারাজীবন সঞ্চিত থাকা- এসব গভীরভাবে বিবেচনা করলে বোঝা যায়, কবির শৈশবমন অবচেতনেই সারাজীবন মুখ ফিরিয়ে রেখেছে সেসব শিল্পাবেদনময় স্মৃতিপঞ্জির দিকে এবং সেসবই কবির মনকে কাব্যফসলের সম্ভাবনাময় উর্বর জমি করে তুলেছে।
দেখেছি সমুদ্রতীরে অস্তরাগে একদা হাওয়ায়
নর্তকী-শিখার মতো সফেদ তরুণ ঘোড়া এক
মেতেছে খেলায়
[প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে/প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে]
শিক্ষাজীবন এবং প্রথম কবিতাপ্রেম
শামসুর রাহমানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ পোগজ স্কুলে। ১ঌ৩৬ সালে এ স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। এ স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় ছোট বোন নেহারের মৃত্যুতে একটি কবিতা লেখেন। কবির মতে ওই কবিতাটি "শোকার্ত বালকের কাছে তার অন্তর্গত সত্তার পত্রলেখা।'
কালের ধুলোয় লেখা] পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছিন্নমুকুল কবিতার ভাব ধরেই লেখা হয়েছিল শৈশবের সেই কবিতা। জীবনের প্রথম এই কাব্য প্রয়াস দিয়ে শোক জাগিয়ে তুলে মাকে কাঁদিয়ে ছিলেন।
নিতান্ত বালকসুলভ এ কাব্যকর্মকে বাতিল করে দেওয়ার আগে আমাদের ভাবতে হয় যে, সপ্তম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় শামসুর রাহমানের কবিতার উপযোগ সম্পর্কে সুষ্পষ্ট একটি অভিজ্ঞান লাভ করেছেন। অপ্রকাশ্য বেদনার ভার কবিতায় চাপিয়ে দেওয়ার উপলব্ধি যে তখনই তাঁর তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
ম্যাট্রিকুলেশনে পাঠ্য ছিল রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের কয়েকটি গল্প। ১ঌ৪৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার পর অবসরে রবীন্দ্রনাথে গল্পগুচ্ছের বাকি গল্পগুলো পড়ে ফেলেন শামসুর রাহমান। এই প্রথম 'অকেজো' পাঠে তার আগ্রহ দেখা যায়। কিছুদিন পর সদস্য হয়ে যান পুরনো ঢাকার অবস্থিত ব্রাহ্মসমাজের রামমোহন পাঠাগারের। এ সুবাদে পড়া হয়ে যায় বন্কিম ও শরৎ চন্দ্রের রচনা। পরবর্তী জীবন কবিতালগ্ন হলেও কবিতা দিয়ে শুরু হয়নি তাঁর পাঠাভ্যাস, শুরু হয়েছে গদ্য দিয়ে। পাঠলগ্ন জীবন শুরু হয় ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পড়ার সময়। আর এ সময় একটি ঘটনা ঘটে যা তাঁর জীবনের মোড় কবিতার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার পেছনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয়। তখন কবির পরিবার থাকে ৩০ নং আশেক লেনে এবং ১৭ নং আশেক লেনে থাকে শিল্পী হামিদুর রহমানদের পরিবার। একদিন রাস্তা থেকে শামসুর রাহমানকে ডেকে নিয়ে যান হামিদুর রহমান। শামসুর রাহমানের চেহারা দেখে হামিদ মনে করেছিলেন যে, এ-ও কবিতা লেখে। ১৭ নং আশেক লেনের বাড়িতে যাওয়া আসার সুবাদে ঢাকার তখনকার প্রথমসারির শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মীদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ট পরিচয় ঘটে। হামিদুর রহমানের বড় ভাই নাজির আহমেদের বদৌলতে তাঁদের বাড়ির আড্ডায় আসতেন হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও চিত্রকর আমিনুল ইসলাম, মর্তুজা বশীর প্রমুখ। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে কাছ থেকে কথাসাহিত্যিক আবু রুশদ, মতিনউদ্দিন ও লোক গবেষক মহম্মদ মনসুর উদ্দীনের মতো শিক্ষককে দেখা হয়ে গেছে তাঁর। এরই মধ্যে ঢাকা কলেজের আরেক শিক্ষার্থী মোশাররফ হোসেন চৌধুরী একদিন তাঁর লেখার খাতাটি পড়তে দেন শামসুর রাহমানকে। মোশাররফ নিজেকে প্রতিশ্রুতিশীল লেখক মনে করতেন সবসময়। মোশাররফও যেতেন হামিদুর রহমানদের বাড়ির আড্ডায়।
হামিদুর রহমানদের বাড়ির আড্ডার সংস্পর্শেই শামসুর রাহমানের মনে সৃষ্টির বাসনা জেগে ওঠে। সেই সময় হঠাত্ এক মেঘলা দিনের দুপুরে নিজের মনের ভার ঢেলে দেন কবিতায়। সেই কবিতা পড়ে শুনিয়ে ছিলেন হামিদুর রাহমানকে। হামিদ তাঁকে উত্সাহিত করেন খুব। হামিদই তাঁকে লেখার জন্য একটানা উত্সাহ যুগিয়ে যেতে থাকেন। তাঁরই উত্সাহে শামসুর রাহমান নলিনীকিশোর গুহ সম্পাদিত সেকালের বিখ্যাত সাপ্তাহিক 'সোনার বাংলা'য় (ঢাকা থেকে প্রকাশিত) কবিতা পাঠান। তখন �সোনার বাংলা�য় লিখতেন জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো প্রথিতযশা কবিরা। ১ঌ৪ঌ সালের ১ জানুয়ারি 'সোনার বাংলা'য় শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা ছাপা হয়। সেই কবিতার নাম 'তারপর দে ছুট'। ১ঌ৪৭ সালে আইএ পাশ করার পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। স্নাতক সম্মান পড়া শেষ বছর পর্যন্ত চালিয়ে গেলেও পরীক্ষায় অবতীর্ণ হননি। কবির এলোমেলো জীবনের কারণে কয়েক বছর শৈল্পিক অপচয়ে কেটে যায়। ১ঌ৫৩ সালে পাস কোর্সে স্নাতক পাশ করেন। মাস্টার্স ভর্তি হয়ে প্রথম পর্ব কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন, কিন্তু শেষ পর্বের পরীক্ষায় আর বসা হয়নি। ১ঌ৫৫ সালের ৮ জুলাই লেখাপড়া মাঝপথে অসমাপ্ত রেখেই আত্মীয়া জোহরা বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
জীবনবিরোধী শ্বাপদের খুরে মগজের কোষ
ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়৷
[তবে মননেও/আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি]
কবিতা ও রাজনীতি
রাজনীতি থেকে বরাবরই দূরে থাকতে চেয়েছেন শামসুর রাহমান। তবে রাজনীতি তাঁর কাছে আদৌ উপেক্ষার বিষয় ছিল না। রাজনীতি থেকে দূরে থাকা সারাজীবনের স্বভাব-লাজুক কবির জন্যে স্বাভাবিক। তাছাড়া কবির পেশাগত অবস্থানও ছিল সক্রিয় রাজনীতির প্রতিকূল। তারপরও বারবারই তাঁকে আমূল নাড়িয়ে গেছে বাঙালির শোষণ-পীড়ন ও বঞ্চনার বিভিন্ন বিষয়। রাজনীতির দানব যতবার হামলে পড়েছে বাঙালির ওপর ততবার তিনি বাঙালির জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন। জনগণের পক্ষে সাড়া দিয়েছেন। তাঁর এ সাড়া এসেছে অধিকাংশ সময়ই কবিতার মাধ্যমে এবং কখনো কখনো কবির অবস্থান থেকে সরাসরি।
শৈশবে বাবাকে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের কৃষকপ্রজা পার্টির সাথে জড়িত থাকতে দেখেছেন। পার্টির হয়ে ফজলুল হকের অনুরোধে ১ঌ৩৭ সালে রায়পুরা ও পাড়াতলীর জনগণের প্রতি ভালোবাসার টানে নির্বাচনেও অংশ নিয়েছেন তাঁর বাবা। মুসলীম লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী খাজা মোহাম্মদ সেলিমের কাছে হেরে যান তিনি। বাবার অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁর চেতনায়ও প্রবাহিত ছিল।
বারবার তাঁর বিরুদ্ধে বিতর্ক তুলেছে কূপমণ্ডুকরা। কূপমণ্ডুকরাই শুধু নয়, বন্ধু ও সমগোত্রীয়দের বিরোধিতাও ছিল। ১ঌ৬৩ সালে কবির 'রৌদ্র করোটিতে' কাব্যগ্রন্থ যাতে আদমজী পুরস্কার না পায় সেজন্য অনেকে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছিলেন। কূপমণ্ডুকরা শুধু বিতর্ক তুলেই থেমে থাকেনি। বর্বরতার চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত গিয়েছে। কবির মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছে। বাসায় হামলা করেছে তাঁকে হত্যা করার জন্য। এতকিছুর পরও কবি তাঁর বিশ্বাসের জায়াগায় ছিলেন অনড়। প্রগতিশীলতার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ শামসুর রাহমান জীবনাচার দিয়ে, প্রাত্যহিক শিষ্ঠাচার ও সৌজন্য দিয়ে বদলে দিতে চেয়েছেন বাঙালির আদিব্যাধির মতো অভ্যাসগুলো। যে অভ্যাস ও আচার পরোক্ষত গোঁড়ামি আর মৌলবাদের উত্সজাত। ন্যায়, যুক্তি ও প্রগতির পক্ষের সাহসী যোদ্ধা শামসুর রাহমান তত্কালীন স্বৈরশাসক তথাকথিত লৌহমানব ফি.মা. আইয়ুব খানকে বিদ্রূপ করে ১ঌ৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত 'সমকাল' পত্রিকায় লেখেন 'হাতির শুঁড়' কবিতা।
বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাঁকে উদ্দেশ্য করে লেখেন অসাধারণ কবিতা 'টেলেমেকাস' (১ঌ৬৬ বা ১ঌ৬৭ সালে)। গ্রীক পুরানের বীর ইউলিসিসের পুত্র টেলেমেকাস। পিতা দীর্ঘদিন রাজ্য ইথাকায় অনুপস্থিত। পিতার প্রত্যাবর্তনে পুত্র টেলেমেকাস সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলছে:
তুমি কি এখনো আসবে না? স্বদেশের পূর্ণিমায়
কখনো তোমার মুখ হবে না উদ্ভাসিত, পিতা,
পুনর্বার? কেন আজও শুনি না তোমার পদধ্বনি৷
[গ্রন্থ: নিরালোকে দিব্যরথ
১ঌ৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দিন রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করেন। শামসুর রাহমান তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা 'দৈনিক পাকিস্তানে' কর্মরত। পেশাগত অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন দৈনিক পাকিস্তানের হাসান হাফিজুর রহমান, আহমেদ হুমায়ুন, ফজল শাহাবুদ্দীন ও শামসুর রাহমান। ১ঌ৬৮ সালের দিকে পাকিস্তানের সকল ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেন আইয়ুব খান। আগস্টে ৪১ জন কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন। কবিও তাঁদের একজন ছিলেন। এছাড়া তখন এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি লেখেন মর্মস্পর্শী কবিতা 'বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা' [গ্রন্থ: নিজ বাসভূমে]।
১ঌ৭০ সালের ২৮ নভেম্বর ঘূর্ণিদুর্গত দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় ও মৃত্যুতে কাতর কবি লেখেন 'আসুন আমরা আজ' ও 'একজন জেলে'। মৃত ও দুর্গতের দেখে এসে পল্টন ময়দানে এক মর্মস্পর্শী বক্তব্য রাখেন মৌলানা ভাসানী। ভাসানীর ব্যক্তিত্ব ও বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখেন 'সফেদ পাঞ্জাবি' কবিতা। কবিতাটি �সাপ্তাহিক বিচিত্রা�য় ছাপা হয় এবং পরে 'শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা' গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১ঌ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে চলে যান নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে। এপ্রিলের সাত বা আট তারিখে পৌঁছেই তিনি লেখেন যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত ও বেদনামথিত কবিতা 'স্বাধীনতা তুমি' ও 'তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা' [গ্রন্থ: বন্দির শিবির থেকে]।
১ঌ৬ঌ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর। কর্মস্থলে তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে সেই শার্ট, সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেও এ দৃশ্য ভোলা সম্ভব হয় না। সন্ধ্যায় একটানে লিখে ফেলেন 'আসাদের শার্ট' কবিতাটি৷ লিখে পরে নিষ্কৃতি পান তিনি। ১ঌ৮৭ সালে স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে 'দৈনিক বাংলা'র প্রধান সম্পাদকের পদে ইস্তফা দেন কবি। এ সিদ্ধান্ত ছিল শামসুর রাহমানের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, কেননা ঢাকায় থাকার মতো তখনো কোনো নিবাস ছিল না কবির, অর্থ উপার্জনের ছিল না কোনো বিকল্প রাস্তা৷ তাছাড়া তখন কবির ফুসফুসেও দেখা দিয়েছে সমস্যা। সব মিলিয়ে প্রচণ্ড দুঃসময় কবির ব্যক্তিগত জীবনে। জাতীয় জীবনের দুঃসময়ে নিজের কথা ভুলে কবিতাকে অস্ত্র মেনে দুঃশাসন অবসানের আন্দোলন চালিয়ে গেলেন কবি। ১ঌ৮৭ থেকে পরবর্তী চার বছরের প্রথম বছরে 'শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা', দ্বিতীয় বছরে 'স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা', তৃতীয় বছরে 'সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা' এবং চতুর্থ বছরে 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা' লেখেন তিনি। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১ঌঌ০ সালে স্বৈরাচারের অবসান ও গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রা প্রত্যক্ষ করে ১ঌঌ১ সালে লেখেন 'গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা'। একজন কবি সক্রিয় রাজনীতিতে কতটা জড়িত ছিলেন তা ততটা বিবেচ্য নয়, বরং কবিতায় তিনি কতটা রাজনৈতিক ছিলেন বিবেচ্য তা-ই।
কতিপয় লোক
নিয়ত গর্জন করে কমিটির বন্ধ ঘরে বর্জনের
খোয়ারিতে, বলে লুপ্ত হোক
শিল্পের প্রদেশ।
স্পষ্ট বলি, আমি ধারি না ধার
নাচের মুদ্রার আর বেহাগের, কাব্যের
ফ্রেস্কোর, নিরঞ্জন সূক্ষ্মতার।
[নিজস্ব সংবাদদাতা/নিরালোকে দিব্যরথ
পেশাজীবন
কবি শামসুর রাহমান ১ঌ৫৭ সালে কর্মজীবন শুরু করেন অধুনালুপ্ত মর্নিং নিউজের সহ-সম্পাদক হিসেবে। ১ঌ৫৮ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে যোগ দেন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে। পরে আবার ফিরে আসেন ঊর্ধ্বতন সহ-সম্পাদক হিসেবে মর্নিং নিউজ পত্রিকায়। মর্নিং নিউজে ১ঌ৬০ থেকে ১ঌ৬৪ পর্যন্ত কাজ করেন। ১ঌ৬৪ সালে পত্রিকা জগতে নতুন আসা সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলা দৈনিক 'দৈনিক পাকিস্তানে' (অধুনালুপ্ত 'দৈনিক বাংলা') যোগ দেন সহকারী সম্পাদক হিসেবে৷ দীর্ঘ ১৩ বছর কাজ করার পর ১ঌ৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি 'দৈনিক বাংলা' এবং এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান 'সাপ্তাহিক বিচিত্রা'র সম্পাদক নিযুক্ত হন। এ সময় 'একটি মোনাজাত' কবিতা লেখার কারণে সরকারের রোষানলে পড়েন তিনি। এ সময় বাংলা একাডেমী তাঁকে শেক্সপিয়রের হ্যামলেট অনুবাদের দায়িত্ব প্রদান করে। এ কাজের গুরুত্বের বিষয়টি বিবেচনা করে তিনি পত্রিকা থেকে ছয় মাসের ছুটি নেন। এ সময় স্বৈরশাসনের শিকার জনগণের মতো ক্ষুব্ধ কবিও ১ঌ৮৭ সালে তাঁর পদে ইস্তফা দিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। হুমায়ুন আজাদ বলছেন, "সামরিক সরকার তাঁকে চাকরিচ্যুত করে।"
সাংবাদিকতার বাইরে তিনি প্রথম সম্পাদনা করেন লিটল ম্যাগাজিন 'কবিকণ্ঠ'। ১ঌ৫৬ সালে তিনি ছিলেন এটির সম্পাদক মণ্ডলীর সম্পাদক। ১ঌ৮৭ সালে ক্ষণজীবী 'অধুনা' সাহিত্যপত্রের সম্পাদক ছিলেন তিনি। 'সাপ্তাহিক মূলধারা'য় ১ঌ৮ঌ সালে প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন তিনি এবং ১ঌঌ১ সাল পর্যন্ত �মূলধারা�র সাহিত্য সহযোগী পত্রের সম্পাদক ছিলেন। পরে তিনি ১ঌঌ৬ সালে বাংলা একাডেমীর সভাপতি নিযুক্ত হন।
শামসুর রাহমান সাংবাদিকতার খাতিরে বিভিন্ন সময়ে বেশকিছু ছদ্মনাম গ্রহণ করেছেন। পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে এসব ছন্দনাম নিতে হয়। নামগুলো হচ্ছে: সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাক। একবার মাত্র কবিতার প্রয়োজনে ছদ্মনাম নিয়েছেন তিনি। পাকিস্তান সরকারের আমলে কলকাতার একটি সাহিত্য পত্রিকায় 'মজলুম আদিব' (বিপন্ন লেখক) নামে কবিতা ছাপা হয়। তার সে নামটি দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট সমালোচক আবু সায়ীদ আইয়ুব।
মোমের মতন সুখী মুখ তুলে বলে এঁকেবেঁকে, ইশ,
দিনরাত্তির মধুভুক সেজে পদ্য বানায়, ওহো, কি
রাবিশ!
[রূপালি স্নান/প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে]
গ্রন্থপঞ্জি
শামসুর রাহমানের গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। বিভিন্ন ভাষায় তাঁর কবিতা অনুদিত হয়েছে। ১ঌ৭৫ সালে কলকাতা থেকে কবীর চৌধুরীর অনুবাদে প্রকাশিত হয় �শামসুর রাহমান: সিলেকটেড পোয়েমস�। কবিতার বাইরেও বিভিন্ন সময়ে তাঁর রচিত শিশুসাহিত্য, অনুবাদ, গল্প, উপন্যাস, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক গদ্য নিয়ে বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বেশকিছু জনপ্রিয় গানের গীতিকারও তিনি।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে
ক্রমিক
বইয়ের নাম
প্রকাশকাল
ক্রমিক
বইয়ের নাম
প্রকাশকাল
১
প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে
১ঌ৬০
২৭
অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই
১ঌ৮৫
২
রৌদ্র করোটিতে
১ঌ৬৩
২৮
হোমারের স্বপ্নময় হাত
১ঌ৮৫
৩
বিধ্বস্ত নীলিমা
১ঌ৬৭
২ঌ
শিরোনাম মনে পড়ে না
১ঌ৮৫
৪
নিরালোকে দিব্যরথ
১ঌ৬৮
৩০
ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই
১ঌ৮৫
৫
নিজ বাসভূমে
১ঌ৭০
৩১
ধূলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ
১ঌ৮৫
৬
বন্দি শিবির থেকে
১ঌ৭২
৩২
এক ফোঁটা কেমন অনল
১ঌ৮৬
৭
দুঃসময়ের মুখোমুখি
১ঌ৭৩
৩৩
টেবিলে আপেলগুলো হেসে ওঠে
১ঌ৮৬
৮
ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা
১ঌ৭৪
৩৪
দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে
১ঌ৮৬
ঌ
আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি
১ঌ৭৪
৩৫
অবিরল জলাভূমি
১ঌ৮৬
১০
এক ধরনের অহংকার
১ঌ৭৫
৩৬
ঝর্ণা আমার আঙুলে
১ঌ৮৭
১১
আমি অনাহারী
১ঌ৭৬
৩৭
স্বপ্নেরা ডুকরে ওঠে বারবার
১ঌ৮৭
১২
শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা
১ঌ৭৬
৩৮
খুব বেশি ভালো থাকতে নেই
১ঌ৮৭
১৩
শূন্যতায় তুমি শোকসভা
১ঌ৭৭
৩ঌ
মঞ্চের মাঝখানে
১ঌ৮৮
১৪
বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে
১ঌ৭৭
৪০
বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়
১ঌ৮৮
১৫
প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে
১ঌ৭৮
৪১
হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো
১ঌ৮ঌ
১৬
প্রেমের কবিতা
১ঌ৮১
৪২
সে এক পরবাসে
১ঌঌ০
১৭
ইকারুসের আকাশ
১ঌ৮২
৪৩
গৃহযুদ্ধের আগে
১ঌঌ০
১৮
উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ
১ঌ৮২
৪৪
খণ্ডিত গৌরব
১ঌঌ২
১ঌ
মাতাল ঋত্বিক ১ঌ৮২
৪৫
ধ্বংসের কিনারে বসে ১ঌঌ২
২০
কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি
১ঌ৮৩
৪৬
হরিণের হাড়
১ঌঌ৩
২১
নায়কের ছায়া
১ঌ৮৩
৪৭
আকাশ আসবে নেমে
১ঌঌ৪
২২
আমার কোনো তাড়া নেই
১ঌ৮৪
৪৮
উজাড় বাগানে
১ঌঌ৫
২৩
যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে
১ঌ৮৪
৪ঌ
এসো কোকিল এসো স্বর্ণচাপা
১ঌঌ৫
২৪
মানব হৃদয়ে নৈবেদ্য সাজাই তোমাকে ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু
১ঌঌ৬
৫০
তুমিই নিঃশ্বাস
তুমিই হৃদস্পন্দন
১ঌঌ৬
২৫
কোকিল হয়েছি
১ঌঌ৭
৫১
হেমন্ত সন্ধ্যায় কিছুকাল
১ঌঌ৭
২৬
ছায়াগনের সঙ্গে কিছুক্ষণ
১ঌঌ৭
৫২
এছাড়া বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা, শামসুর রাহমানের নির্বাচিত কবিতা ও শামসুর রাহমানের রাজনৈতিক কবিতা।
শিশুতোষ গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য
ক্রমিক
বইয়ের নাম
প্রকাশকাল
ক্রমিক
বইয়ের নাম
প্রকাশকাল
১
এলাটিং বেলাটিং
১ঌ৭৫
৪
স্মৃতির শহর
১ঌ৭ঌ
২
ধান ভানলে কুঁড়ো দেবো
১ঌ৭৭
৫
রংধনুর সাঁকো
১ঌঌ৪
৩
গোলাপ ফোটে খুকির হাতে
১ঌ৭৭
৬
লাল ফুলকির ছড়া
১ঌঌ৫
৭
নয়নার জন্য
১ঌঌ৭
অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে
ক্রমিক
বইয়ের নাম
প্রকাশকাল
ক্রমিক
বইয়ের নাম
প্রকাশকাল
১
ফ্রস্টের কবিতা
১ঌ৬৫
৪
খাজা ফরিদের কবিতা
১ঌ৬ঌ
২
মার্কোমিলিয়ানস
১ঌ৬৭
৫
হৃদয়ে ঋতু, হ্যামলেট, ডেনমার্কের যুবরাজ
১ঌঌ৫
৩
রবার্ট ফ্রস্টের নির্বাচিত কবিতা
১ঌ৬৮
৬
সম্পাদনা গ্রন্থ
হাসান হাফিজুর রহমানের অপ্রকাশিত কবিতা (বাং ১৩ঌ২), দুই বাংলার ভালবাসার কবিতা (যৌথভাবে) এবং দুই বাংলার বিরহের কবিতা (যৌথভাবে)।
অন্যান্য গ্রন্থ
শামসুর রাহমানের গল্প, শামসুর রাহমানের প্রবন্ধ, অক্টোপাস (উপন্যাস)।
যে লেখক এবার পেলেন
আদমজি পুরস্কার তিনি প্রত্যহ
মাজেন দাঁত
কলিন্স দিয়ে,
[ছুঁচোর কেত্তন/রৌদ্র করোটিতে]
পুরস্কার ও সম্মাননা
শামসুর রাহমান অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন। তিনি গ্রহণযোগ্যতার এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন যে, অনেক প্রতিষ্ঠানই তাঁকে সম্মানিত করতে পারলে নিজেরা সম্মানিত বোধ করে।
ক্রমিক
সাল
পুরস্কারের নাম
১
১ঌ৬৩
আদমজী পুরস্কার
২
১ঌ৬ঌ
বাংলা একাডেমী পুরস্কার
৩
১ঌ৭৩
জীবনানন্দ দাশ পুরস্কার
৪
১ঌ৭৭
একুশে পদক
৫
১ঌ৮১
আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার
৬
১ঌ৮১
নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক ও পদাবলি পুরস্কার
৭
১ঌ৮২
মৌলানা ভাসানী পুরস্কার
৮
১ঌঌ১
স্বাধীনতা পুরস্কার
৯
১ঌঌ২
জাপানের মিত্সুবিশি পদক (সাংবাদিকতায়)
১ঌঌ৪
ভারতের আনন্দ পুরস্কার
এছাড়াও আরো অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি।
ভারতের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি প্রদান করেছে। শামসুর রাহমানকে প্রথম বড় মাপের সংবর্ধনা প্রদান করা হয় ১ঌ৭ঌ সালের ২৪ অক্টোবর। পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে শামসুর রাহমান সংবর্ধনা পরিষদ বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে তাঁকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে।
এছাড়া কবি ও সাংবাদিক হিসেবে সম্মানিত হয়ে তিনি ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া), বার্মা (মায়ানমার), পশ্চিম জার্মানি (সাবেক), যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন।
পরিবার ও সন্তান-সন্তুতি
বাবা মোখলেসুর রাহমান চৌধুরীর প্রথম পক্ষের স্ত্রী তিন পুত্র রেখে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই ছোটবোন আমেনা বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। আমেনা বেগমের ১০ সন্তানের মধ্যে শামসুর রাহমান জ্যেষ্ঠ। শামসুর রাহমানরা চার ভাই ও ছয় বোন।
১ঌ৫৫ সালে শামসুর রাহমান বিয়ে করেন আত্মীয়া জোহরা বেগমকে। দুজনই দুজনকে আগে থেকেই পছন্দ করতেন। পরবর্তীতে পারিবারিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে ঘটা করেই তাঁদের বিয়ে হয়। শামসুর রাহমান দম্পতির পাঁচ সন্তান (তিন কন্যা ও দুই পুত্র)। তারা হলেন যথাক্রমে সুমায়রা রাহমান (১ঌ৫৬), ফাইয়াজুর রাহমান (১ঌ৫৮), ফৌজিয়া রাহমান (১ঌ৫ঌ), ওয়াহিদুর রাহমান মতিন (১ঌ৬০-১ঌ৭ঌ) এবং সেবা রাহমান (১ঌ৬১)। ১৭ই আগস্ট ২০০৬ সালে কবি ইন্তেকাল করেন।
তথ্যসূত্র:
•কালের ধুলোয় লেখা: শামসুর রাহমানের আত্মজীবনী
•স্মৃতির শহর: শামসুর রাহমানের স্মৃতিচারণমূলক শিশুতোষ গ্রন্থ
•হুমায়ুন আজাদের গ্রন্থ "শামসুর রাহমান/ নিঃসঙ্গ শেরপা"
•বাংলা একাডেমী লেখক অভিধান: বাংলা একাডেমী (১ঌঌ৮)
•সাংবাদিকের সংবাদ: এমএ মান্নান সম্পাদিত
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment