| Home | Menu | Poems | Poets | Reading | Theme | Biography | Articles | Photo | Dictionary | Chat | Video | Shop | Extra | Jokes | Games | Science | Bio | বাংলা

সুকুমার বড়ুয়া Sukumar Borua Biography 1938-



জীবনের প্রথম লেখাটি লেখা হয়েছিল বৃষ্টি নিয়ে ৷ বিশ বছর বয়স তখন তাঁর ৷ অথচ বিগত জীবনের কোথাও বৃষ্টি নিয়ে একবারও ভাবার অবকাশ হয়েছিল কিনা তা তাঁর জীবন পর্যালোচনা করে কোন গবেষকই বের করতে পারেননি ৷ কবিরা এমনই হন ৷ বায়োগ্রাফি লেখার সময় শিক্ষাগত যোগ্যতার জায়গায় লেখেন 'স্বশিক্ষিত' ৷ মননশীলতার কোন অভাবই যার ভেতর নেই তাঁর বায়োগ্রাফিতে বড় বড় ডিগ্রির তালিকা নেই কেন সেই তত্ত্ব উদ্ধারের জন্য আমাদের ফিরে যেতে হয়েছে তাঁর শৈশবে, কৈশোরে ৷ কি ছিল সেই কিশোরের মনে, যে ঘর পালায়নি কিন্তু ঘরই তার কাছ থেকে পালিয়েছিল ৷ মাকে তাঁর ভীষণ মনে পড়ত ৷ মা কিন্তু ছিলই ৷ ছিল না সংসারে স্বচ্ছলতা ৷ যদি বলি শৈশবের শুরুতেই শিশু শ্রমিকের কাজ করেছেন, তা হলে কি মনে হবে যে আর এক নজরুলের গল্প বলছি ৷ জীবনে হার না মানা সব মানুষের গল্পই আসলে এক ৷ একদিন বাজি ধরে পনের টাকা মাইনের চাকরি ছেড়ে চলে এসেছিলেন এই শহরে ৷ কিন্তু বাজিতে হারেননি তিনি ৷ শৈশবে চায়ের দোকানে কাজ করেছেন, বাদাম বিক্রি করেছেন, ফেরি করে আইসক্রিম বিক্রি করা সেই যুবক, যিনি আইসক্রিমের বাক্সের ভেতর নিজস্ব স্বপ্ন নিয়ে বহুদিন ঘুরে বেড়িয়েছেন শহরের সমস্ত পীচ রাস্তা ধরে ৷ তিনি আমাদের সুকুমার বড়ুয়া ৷ ছড়াকার ৷ আমরা তাঁর আনন্দ বেদনার কাব্য সংযুক্ত করলাম ৷

If you cannot view the fonts properly please download and Install this file.

জন্ম

সুকুমার বড়ুয়া জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার মধ্যম বিনাজুরি গ্রামে ৷ ৫ জানুয়ারি, ১৯৩৮ সালে ৷ পিতার নাম সর্বানন্দ বড়ুয়া ৷ মা কিরণ বালা বড়ুয়া ৷ বাবার পয়সা ছিলনা মোটেই ৷ কিন্তু একটা ছেলের শখ ছিল ৷ সেই শখের ধারাবাহিকতায় তিনি বাবা মায়ের তেরতম সন্তান ৷

মহাদেব থেকে সুকুমার

বিভূতিভূষনের পথের পাঁচালীর মতোই সুকুমার বড়ুয়ার এক বোনের নাম ছিল দূর্গা ৷ তাঁকে তিনি দেখেননি ৷ তাঁর পিঠোপিঠি বড় যে বোন , তাঁর নাম ছিল পূজা ৷ পথের পাঁচালীর মতোই দুরন্ত দুই শিশু প্রকৃতির কোলে কোলে ঘুরতেন ৷ পূজা দিদি তাঁকে চেনাতেন গাছপালা, নদী ৷ আর পাখি চেনাতো না ৷ খুব চেনাতো ৷ যে আকাশ চেনায় সে পাখিও চেনে ৷ দিদি কিন্তু গল্পও জানতো ৷ দুইটা মাত্র গল্প ৷ শোনাতো, রাতে শোবার সময় ৷ ঘুরে ফিরে সেই দুটো গল্পই ৷ তার একটা শিয়াল আর ঘুঘু পাখির, আরেকটি পিঠে গাছের গল্প ৷
পূজা দিদির সাথে বাবা সর্বানন্দ বড়ুয়ার কথা হতো ঘুমুতে যাবার আগে ৷ দিদি কি নিয়ে আলাপ করতো বাবার সাথে ? গল্প শোনাতো ? পিঠে গাছের গল্প ? না, আলাপ হতো নাম নিয়ে ৷ ছোট ভাইটির নাম কি হবে তা নিয়ে বোনটির চিন্তার অন্ত ছিল না ৷ হিন্দু মহাভারতের অনেক অনেক পাত্র পাত্রীর নাম তাঁদের দুজনেরই জানা ছিল ৷ ফলে প্রতিদিনই নাম বদলে যায় ৷ আজ অর্জুন তো কাল নকুল ৷ তারপরদিন মহাদেব ৷ তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে ৷ সেই প্রভাবে কোনকোন দিন তাঁর নাম চীন, জাপান, আমেরিকাও হয়েছে ৷ সেই নাম চীন জাপান ঘুরে সুকুমার বড়ুয়া কি করে হলো তাও জানা গেল ৷ তাঁর মামা বাড়ি ছিল তাঁদের বাড়ি থেকে উন্নত ৷ অর্থাত্‍ অবস্থাসম্পন্ন ৷ ফলে তাদের পরিবাবের প্রতি মামাদের প্রভাবও কম ছিলনা ৷ বাবা আর দিদির প্রস্তাবিত নাম শুনে মামীমা একদিন নাক শিটকোলেন ৷ কি বিশ্রী নাম ৷ তোমার নাম হবে সুকুমোল কিংবা সুকুমার ৷ ফলে এক দিদির নাম রাখার স্বপ্ন মাঠে মারা পড়ল ৷ মহাদেব কিংবা অর্জুন কিংবা নকুল হয়ে গেলেন সুকুমার বড়ুয়া ৷

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও বাবার নিরুদ্দেশ

তখন ১৯৪৩ সাল ৷ দুর্ভিক্ষের বছর ৷ সারা পৃথিবী জুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মর্মান্তিক কালো ছায়া ৷ সুকুমার বড়ুয়ার বয়স তখন মাত্র পাঁচ ৷ বাড়িতে, পুরো পরিবারে বড় দুই বোনসহ পাঁচজন সদস্য ৷ কোন জমিজমা নেই ৷ বাবা হাটবাজারে ছোটখাট বেচাকেনা করতেন ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াল থাবায় জনজীবন বিপর্যস্ত ৷ জিনিসের দাম হু হু করে বাড়ছে ৷ অনাহারে অর্ধাহারে থেকে ভিখিরীর সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন ৷ চাল কেনার মত কোন গরীব নেই ৷ কদিন আগেও টাকায় পাঁচ সের চাল পাওয়া যেত ৷ এখন টাকায় তিন পোয়া ৷ পুরো পরিবারটি চলছে শুধু শাক সেদ্ধ খেয়ে ৷ রুচি বদলের জন্য কোন কোন দিন কলার থোড় কখনোবা ভাতের মাড় খেয়ে দিন যাপন করতে হয়েছে ৷ কোনকোন দিন তাও জুটতো না ৷ ১৯৪৩ সাল আমাদেরকে অনেক উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়েছিল ৷ মানুষ আগে যা খাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারতো না সেই সব 'খাদ্য তালিকা' থেকে কি কি খাদ্য খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে, তখন আমরা আবিস্কার করেছি ৷ ঘরে ঘরে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি ৷ আপনজনকে ফাঁকি দিয়ে কে বেশি খেতে পারে সেই নীরব প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার কলাকৌশলও মানুষ রপ্ত করে ফেলেছে ৷ চট্টগ্রামের মধ্যম বিনাজুরি গ্রামের বড়ুয়া পরিবারের ছনে ছাওয়া দোচালা বেড়ার ঘরে সেই প্রতিযোগীতার রেশ মাত্র নেই ৷ খাদ্যই নেই আর খাওয়ার প্রতিযোগীতা! বাবা একদিন সুকুমারের হাতে তাঁদের একমাত্র বালতিটা দিয়ে বললেন, তোর জেঠাদের দিয়ে আয় আর বলিস যেন দুই সের চাল দেয় ৷ লজ্জায় বাবা নিজে যেতে পারেননি ৷ সেই বালতি নিয়ে সুকুমার বোবার মত কিছুক্ষণ জেঠাদের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন ৷ ফিরেও আসেন ৷ কিছুই বলতে পারেননি ৷ এরপর বাবা যান ৷ বালতির বদলে চালও আনেন ৷
ঘরেতো দেবার মত আর কিছুই ছিলনা ৷ এভাবে আর কতদিন চলে ৷ অনেক শখের শিশুপুত্র আর বাড়িতে পাঁচ পাঁচটা মুখ ৷ এই হাহাকার সারা পৃথিবীর মত বাবার বুকের মধ্যেও বেজেছিল ৷ একসময় বাবা বেরিয়ে পড়েন ভাগ্যন্নেসনে ৷ কেউ জানলোনা কোথায় গেলেন ৷ বাবা আর ফিরে আসেননি সুকুমারদের জীবনে, পরিবারে ৷

দুর্ভিক্ষের স্মৃতি ও লঙ্গরখানার খিচুড়ি

মধ্যম বিনাজুরি গ্রামে যে বাড়িটিতে সুকুমার বড়ুয়া থাকতেন তার কাছাকাছিই কয়েকটি হিন্দু বাড়ি ছিল ৷ বৌদ্ধ পল্লীর অনেকেই সেখানে ধান ভানার কাজ করতো ৷ সুকুমারের মাও সেখানে ধান ভানতেন ৷ কখনও সেখানে কাজ করে আবার কখনোবা মামার বাড়ি থেকেই অন্নের সংস্থান হতো ৷ মা নিজেই অন্নের সংস্থান করতেন ৷ তিনি হঠাত্‍ একদিন এসে সুকুমারকে মামার বাড়ি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন ৷ সুকুমারের এক স্নেহময়ী জেঠিমা ছিলেন ৷ তাকে তিনি দুদুমা বলে ডাকতেন ৷ তাঁর একছেলে বঙ্কিমকে বিকৃতভাবে 'বেইঙ্গা' ডাকা হতো ৷ দুদুমার এক মেয়ে বিবাহিতা, নাম খুকি ৷ সেই দুদুমা সুকুমারকে মামা বাড়ি নিয়ে যাবেন ৷ কাগতিয়া হাটে ঢুকতেই দুদুমা থামলেন একটি চায়ের দোকানের সামনে ৷ সেই চা দোকানে আছে তাঁর একমাত্র মেয়ে খুকি ৷ খুকিদি সেই চায়ের দোকানে কাজ করতেন কিছু খাদ্যের বিনিময়ে ৷ সেদিন সুকুমার দুই কাপ চা আর একখানা কচুরি খেয়েছিলেন ৷
ইতোমধ্যে দুদুমা গিয়েছেন খিচুড়ির রান্না দেখতে ৷ সুকুমার বসে আছেন চায়ের দোকানে ৷ অত্যন্ত মনোযোগের সাথে বসে বসে চা বানানোর কায়দা কানুন দেখছেন ৷ দেখছিলেন কেমন করে চা ছাঁকে আর চামচ নাড়ে ৷ দুজনের ভঙ্গি দুরকমের ৷ একটা ভিখারীর ছেলে সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে ৷ দোকানি পাঁউরুটির চামড়া ছুঁড়ে ফেলছে আর ছেলেটি পাখির মতো টুপ করে কুড়িয়ে তা মুখে দিচ্ছে ৷ একসময় দুদুমা সুকুমারকে লঙ্গরখানার খিচুড়ি খাওয়াতে নিয়ে যান ৷ সাথে বেইঙ্গাদা'ও আছে ৷ বুটের ডাল চাল মেশানো মজার খিচুড়ি ৷ কর্তাবাবুদের একজন বেইঙ্গাদাকে বললেন, এই তুই আরও একবার খেয়েছিস ৷ সঙ্গে সঙ্গে দুদুমা বললেন, কখন খেয়েছে ? তুই দেখেছিস ? কথাটা আসলে সত্য ছিল ৷ শুধু বেইঙ্গাদা কেন, অনেকেই দিনের বেলাতেই রাতের ভাগটা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করত ৷ রাতে আবার খাবার জোটার সম্ভাবনা ক্ষীণ ছিল ৷ সানকিতে ও কলাপাতায় খিচুড়ি খাওয়ার জন্য কুকুর আর মানুষ মিলে যে কি এক ভয়াবহ অবস্থা! খোদ ঢাকাতে বসেই সেই দৃশ্য আরো একবার দেখেছেন সুকুমার বড়ুয়া ৷ সেটা ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় ৷ জাতীয় সংসদ ভবনের লঙ্গরখানায় ৷

অবশেষে মামাবাড়িতে আসা হল ৷ এখানে খাওয়দাওয়ার সুবিধা ছিল কিছুটা বেশি ৷ সুকুমারের আপন মামারা গরীব হলেও তাঁদের প্রতিবেশীরা ধনী ছিলেন ৷ মামার দুই জেঠতুতো ভাই রামজীবন সওদাগর আর রামজীবন মহাজনের বেশ নামডাক ছিল ৷ কিন্তু বড়লোক হলেই বা কি ৷ রাত পোহালেই ভিখারীর ঠেলা সামলাতে অস্থির হয়ে পড়তেন তাঁরা ৷ তখন এমন সব হিন্দু মুসলিম পরিবারের মহিলারা ভিক্ষায় নেমেছিল, যা কেই ভাবতেও পারতো না ৷ কোন কোন একরোখা ভিখারী গোঁ ধরতো চাল ধোয়া পানি হলেও খাবে, তবুও যাবেনা ৷ পেটের জ্বালা সহ্য করা কঠিন ছিল ৷

হীরাবালা ৷ সেখানকারই এক পাগলী, যার কথা হয়তো এখনও সেখানকার মানুষের মুখে মুখে শোনা যাবে ৷ অনেকেই তাকে এমন সব অখাদ্য খেতে দেখেছে যে আজকের মানুষতো বটেই সেই সেদিনেও অনেকের গা শিউরে উঠতো ৷ কত বাড়ি বাড়ি ঢুকে খাবার লুট করে খেয়েছে সে! এরজন্য মারও কম খায়নি ৷ অনেকে লাঠি দিয়েও মেরেছেন ৷ কিন্তু সরানো যায়নি তাকে ৷ মার খেয়ে কাঁদতেও দেখেনি তাকে কেউ ৷ সেই লাঠির মার, মানুষের ক্ষুধার্ত মুখ, মারমুখো ভঙ্গি, দমাতে পারেনি হীরাবালাকে ৷

পূজাদিদি

সেই পূজাদিদি ৷ যিনি বিভূতিভূষনের দূর্গার মতো ছিলেন সুকুমারের জীবনে ৷ অভাবে, নাখেতে পেয়ে অথবা লঙ্গরখানার খিচুড়ি আর জাউ খেয়েও হতে পারে , দিদির হাত পা ফুলে গেছে ৷ চেহার বিকৃত হয়ে গেছে ৷ তখন সুকুমারের বয়স আট, নয় ৷ আর দিদি তের, চৌদ্দ বছরের ৷ একদিন মধ্যম বিনাজুরির সেই দোচালার ছনের ঘরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন ৷ সুকুমার তখন বড় দিদির বাড়ি ৷ পূজাদিদির সাথে সেই সুকুমারের শেষ দেখা ৷ এক রাত্রে বড়দিদির বাড়ি চলে আসাতে বড়দিদি খুব রেগে গিয়েছিলেন ৷ এমনিতেই দু, একজনকে পুষতে গিয়ে কত ঝুঁকি নিয়েছেন, তার মধ্যে আরও একজন ৷ পরে শুনেছিলেন প্রতিবেশিরা সংক্ষেপে শেষকৃত্য সেরেছেন ৷ এর পনের বছরপর পথের পাঁচালী পড়তে গিয়ে দূর্গার সাথে পূজাদিদির মিল দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলেন সুকুমার ৷ দূর্ভাগা দেশে এমনি কত হাজার হাজার অপু দূর্গা যে হারিয়ে গেছে আর কত হরিহরও বাড়িঘর ছেড়ে রোজগারের আশায় জীবন দিয়েছে কে জানে৷

মামাবাড়ির স্মৃতি

মামাবড়িতে মামীমাকে খুব ভয় পেতেন সুকুমার ৷ কারণ সে বাড়িতে শিক্ষাকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হতো ৷ যে বিষয়টি তাঁর নিজের বাড়িতে ছিলনা ৷ বর্ণজ্ঞান থেকে প্রথম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানেই পড়াশোনা করেছেন ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন চরমে পৌঁছেছে ৷ মাথার উপরে রংবেরঙের যুদ্ধ বিমান ৷ মাটিতে কোন মটর গাড়ি দেখা হয়নি ৷ মামাবাড়িতে আশ্চর্য যে জিনিষটি দেখলেন তিনি, সেটি কলের গান ৷ এই মামার বাড়ির কাছে অনেকভাবে ঋণী তিনি ৷
সে সময়ের ১১টি পরিবারের আঠারো বিশটি ঘরের সবকটাই ছিল যেন তাঁর খুব আপন ৷ মামা পুলিশ কনষ্টে বলের চাকুরি করে খুব কম টাকা পাঠান ৷ একবার শুধু দেড় টাকা পাঠিয়েছিলেন ৷ কোন জমিজমা নেই ৷ দিদিমা, মামীমা আর সুকুমার নিজে ছাড়া মাও মাঝে মধ্যে আসতেন ৷ মা আর দুদুমা একত্রে রোজগারের আশায় ছোটাছুটি করতেন ৷ সুকুমারের নিজবাড়িতে একটি বর্গা গাই গরু ছিল ৷ বাছুরসহ সেটার আশ্রয়ও শেষ পর্যন্ত মামাবাড়িতেই হয়েছিল ৷ গাইটা ছিল পাজি ধরনের ৷ সেটাকে সামলাতে হতো সুকুমারকে ৷ ঠিকমতো সামলাতে বা চড়াতে না পারলে বকা খেতে হতো ৷ সেই বাছুরসহ গরু চড়াতে চড়াতে সুকুমার তাদের খাওয়া দাওয়া খুব মনোযোগের সাথে দেখতেন ৷ গরু ছাগলের খাওয়ার ভঙ্গিটা তার কাছে খুব মজার মনে হতো ৷

দেশে দুর্ভিক্ষ আর হাহাকার বেড়েই চলেছে ৷ পথে ঘাটে রোজ অনাহারে মানুষ মরছে ৷ মামাবাড়িতেও চরম অভাব। এরমধ্যেই একদিন সেই দুদুমা এলেন সুকুমারকে বড়দিদির বাড়ি নিয়ে যেতে ৷ দুদুমা বেশ খুশি হয়ে মাকে জানালেন, বুড়ি তোর ছেলেকে নিয়ে যাব ৷ বড়দিদির বাড়ির অবস্থা ভালো ৷ সুকুমারের ভগ্নিপতি ছিলেন গ্রামের মেম্বার ৷ তাতে কি ৷ বাবার জন্য সকলের আক্ষেপ কিন্তু ছিলই ৷

আবার তিনি মধ্যম বিনাজুরি গ্রামে ফিরে গেলেন ৷ বড়দিদির বাড়ি তাঁদের নিজ বাড়ির পাশেই ছিল ৷ সুকুমারের রানীদিদি আগে থেকেই বড় দিদির বাড়িতে ছিলেন ৷ ভগ্নিপতির বেশ বড়-সর ধানের গোলা, খড়ের গাদা, বড়বড় গরু ৷ এখানে এসে বহুদিন পর পেটপুরে খাবারের অভিজ্ঞতা হয়েছিল সুকুমারের ৷

মামাবাড়িতে থাকতে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের 'হাসি-খুশি' পুরোটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল ৷ দিদির বাড়িতে এসে সঙ্গী সাথীদের দুএকবার শোনাতেই সবাই ছেঁকে ধরল, আবার শোনাও ৷ সুকুমার কিন্তু সেই শ্রোতাদের হাত থেকে এখনও রেহাই পাননা ৷ কোথাও গেলেই এখনও সেই অনুরোধ ঘুরে ফিরে আসে ৷ নানা একটা ছড়া শোনান ৷ কাকু একটা ছড়া শোনান ৷ এই ছড়ার বীজ সূদুরের সেই শৈশবেই পোতা হয়েছিল বোধহয় ৷ এর আগে মামা বাড়িতে আংশিক অ-আ শিখেছিলেন তিনি ৷ এখানে ভগ্নী সুমতি প্রথমে হাতে লেখা বই, পরে একটি বাল্যশিক্ষা কিনে পড়তে দিয়েছিলেন ৷ স্কুলেও যাওয়া আসা শুরু করলেন ৷ অল্প কদিনের মধ্যে বাল্য শিক্ষা পুরো মুখস্থ দেখে সবাই তো অবাক ৷ অনেকেই সে সময় বলাবলি করলেন, ছেলেটার মাথা আছে ৷

রেলগাড়ি চড়ার অভিজ্ঞতা

হাটহাজারী একটা ছোট শহর ৷ এরমধ্যেই সেখানে রেললাইন নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে ৷ কোন গাড়ি চলেনি ৷ লাইন নির্মাণের সময় অবাক হয়ে ভাবতেন, এর উপর দিয়ে গাড়ি চলবে কিভাবে ? রানীদিদির শ্বশুরবাড়ি ছিল রেল লাইনের খুব কাছেই ৷ চারটার সময় গাড়ি আসবে, গাড়ির কাছে না যাওয়ার জন্য দিদি বার বার সাবধান করে দিলেন সুকুমারকে ৷ সত্যিই গাড়ি এলো একসময় ৷ কী ভয়ংকর বিশাল সেই যন্ত্র দানব ৷ আশেপাশের বাড়িঘর সব যেন থর থর করে কাঁপতে শুরু করল ৷ পরদিন রেলে চড়ে চট্টগ্রাম শহর হয়ে পটিয়া যেতে হবে ৷ সেই স্বপ্নের রেলগাড়িতে চড়া হলো ৷ মাইলপ্রতি একপয়সা হিসাবে নাকি ভাড়া ৷ গাড়ি চলার সময় চমত্‍কার একটা ছন্দের সৃষ্টি হচ্ছিল ৷ হাটহাজারীর পাহাড়সহ গাছপালা সব যেন পটিয়ার দিকে ছুটতে শুরু করল ৷ আর গাড়িটি রইল দাঁড়িয়ে ৷ সেটা ১৯৪৬ সালের কথা ৷

ভাঙা গড়ার আড়াই ক্লাস

মামার বাড়ির ২টি ধর্মশালায় আর দিদির বাড়িতে মোট কতদিন তিনি থেকেছেন, সুকুমার বড়ুয়া আজ আর তা মনে করত পারেন না ৷ শুধুমাত্র দিদির বাড়িতে শেষবার যাওয়া এবং ফাঁকি দিয়ে মুক্ত হবার বিষয়টি তাঁর স্পষ্ট মনে পড়ে ৷ মুক্ত হবার কথাটি বলা হয়েছে এজন্য যে দিদির বাড়ির ব্যাবস্থাটি সুকুমারের প্রিয় ছিল না ৷ সেইবার মামাবাড়ি থেকে তিনি যখন নিজেদের পাড়ার ধর্মশালায় এলেন তখন ধর্মগুরু বেশ চড় থাপ্পড় দিয়ে শ্মশান বিহারে সারানন্দ ভিক্ষুর কাছে যাবার চাপ দিলেন ৷ সরানন্দ ভিক্ষুর শিষ্য থাকাকালে ২য় শ্রেণীতে পড়তেন তিনি ৷ স্কুলের শিক্ষকরাও তাঁর উপর খুশি ছিলেন ৷ কারণ পড়াশোনাটা ভালো হচ্ছিল ৷ কিন্তু সুকুমারের বড়দিদি তা না করে তাঁর নিজের বাড়ি নিয়ে গেলেন পড়াবেন বলে ৷
এই স্কুলের নাম আসলে অন্য ৷ ডাবুয়া খালের পাশে বলে সংক্ষেপে 'ডাবুয়া স্কুল' বলা হয় ৷ সেই স্কুলে একদিন ইন্সপেক্টর আসবেন ৷ মহেশ মাস্টার, রমনী মাস্টার আর সুশীল মাস্টার অনেক সেজেগুজে স্কুলে এসেছেন ৷ গ্রামের শিক্ষার্থীদেরকে যথাসম্ভব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে আসার জন্য স্কুল থেকে নির্দেশ দেওয়া হলো ৷ যথাসময়ে এক দাড়িওয়ালা স্পষ্টভাষী ইন্সপেক্টর এলেন ৷

ছাত্রদের বুদ্ধিসুদ্ধি পরীক্ষা করার তোড়জোড় চলছে ৷ ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণীর সাথে কিছু হাই স্কুলের বড় বড় ছেলেকেও ভেজাল দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে ৷ দাঁড়িওয়ালা ইন্সপেক্টর এসে বললেন, বুদ্ধি ধর বুদ্ধি ধর ৷ সবাই হা করে চেয়ে আছে ৷ ইন্সপেক্টর বললেন, বুঝলে না ? তারপর দুই হাত এক করে পতাকা ধরার মতো করে দেখালেন ৷ কেউ বুঝলোই না ৷ ইন্সপেক্টর প্রথম লাইনের দিকে এলেন ৷ সেখানে আটদশটা ছেলের সাথে সুকুমারও ছিলেন ৷ দাঁড়িওয়ালা এবার ছাত্রদের কাছে মানষাঙ্ক ধরলেন ৷ মানষাঙ্ক হচ্ছে সেই অঙ্ক যা মনে মনে সমাধান করা হয় ৷ প্রথম কয়েকটির উত্তর অন্যরা বলে দিল ৷ সুকুমার তখনও বিষয়টি পুরোপুরি ধরতে পারেননি ৷ এরপর যখন পারলেন অন্যদের আগে আগেই পারলেন ৷ শেষ কয়েকটির উত্তর দেওয়ার কৃতিত্ব তাঁর ভাগ্যেই জুটলো ৷ দাঁড়িওয়ালা ইন্সপেক্টর তাঁর পিঠ চাপড়ে দিলেন ৷ এরপরের অঙ্কটি করতে হলো বিশেষ কায়দায়, স্লেটে ৷ কেউ যাতে কারোটা না দেখে সেজন্য সবাইকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল ৷ এরপর দাঁড়িওয়ালা সবাইকে এগারো হাজার এগারোকে এগারো দিয়ে ভাগ করতে বললেন ৷ ভাগ করাতো দূরে থাকুক, অনেকে এগারো হাজার এগারো লিখতেই পারলো না ৷ সবার অঙ্কই ভুল হয়েছিল ৷ সুকুমারেরটাও ৷ তবে শুধু তাঁর আর ৬ষ্ঠ শ্রেণীর একটা ছেলের উত্তর হয়েছিল একশো এক ৷ দাঁড়িওয়ালা আবার তারিফ করলেন, পিঠ চাপড়ে দিলেন ৷ সেই স্কুলেও কিন্তু তৃতীয় শ্রেণীর পড়াটা শেষ হয়নি সুকুমারের। স্কুলের হেডমাষ্টার চেয়েছিলেন সুকুমারের পড়াশুনাটা যেন বন্ধ হয়ে না যায়। আর তাইতো হেডমাস্টার সুশীল বাবু জানালেন যে তার পরীক্ষার ফি দিতে হবে না ৷ তারপরেও বড় দিদি তাঁকে পরীক্ষা দিতে দেননি ৷ পড়াননি ৷ স্কুলে যাওয়ার সময় বাধা দিলেন ৷ বললেন, যাও গরু ছাগল রাখো, পড়তে হবেনা ৷ বাংলাদেশে কত লক্ষ কিশোরের ভাগ্যে এমন ঘটেছে কে জানে ৷ প্রচুর কাজের চাপে, ব্যবহারের বস্ত্রের অভাবে যখন সুকুমারকে আর মানুষ বলে মনে হচ্ছিল না, তখনই মা এসে তাঁকে সেখান থেকে উদ্ধার করলেন ৷ অন্য গ্রামে তাঁর মাসীর অসুখ, শেষবেলায় তিনি সুকুমারকে দেখতে চান এইসব সাতপাঁচ বুঝিয়ে সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করা হল ৷ এরপর মা তাঁকে প্রথমে মামাবাড়ি তারপর চট্টগ্রাম শহরে দামপাড়া পুলিশ লাইনে নিয়ে গেলেন ৷ মামাবাড়ির লোকেরা তাঁর এই দুরাবস্থার কথা শুনে মাকে এই বুদ্ধি বাতলে দিলেন ৷

চট্টগ্রামের স্মৃতি

মামাবাড়ির সবাই সুকুমারকে খুব স্নেহ করতেন ৷ সেই স্নেহ উপেক্ষা করে তাঁর চট্টগ্রামে যাওয়ার বিষয়ে কথা ঠিকঠাক হয়ে গেছে ৷ তবে এই যাত্রার বিষয়ে মামাতো বৌদিরা অনেক খুশি ছিলেন ৷ কোথাও যাত্রা করার খবরটাই তাঁদের জন্য খুব খুশির একটা বিষয় ছিল ৷ এক বৌদি বললেন, শহরে যাওয়ার সময় দেশের মাটি খেতে হয়, এতে দেশের জন্য মায়াটা বলবত্‍ থাকে ৷ যাত্রার দিন নির্দিষ্ট হলো ৷ লঞ্চে করে যেতে হবে ৷ হালদা নদী দিয়ে লঞ্চ যাবে ৷ এর আগে লঞ্চ দেখা হয়নি ৷ এবার চড়া আর দেখা দুটোই একসাথে হবে ৷ মাথার ভেতর নানা রকম কল্পনা ছিল এই লঞ্চে চড়া নিয়ে ৷ লঞ্চ থাকে পানিতে, তাহলে তাতে উঠতে হবে কি কর? সাঁতরে ? মা বললেন, লঞ্চে ওঠার সিঁড়ি আছে ৷ সব কল্পনার অবসান হলো ৷ লঞ্চে উঠলেনও তিনি, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ৷ তখন চট্টগ্রামের কাপ্তাই যেতে বড়দের আটআনা আর ছোটদের লাগতো চারআনা ৷
চট্টগ্রাম শহরের দামপাড়া পুলিশ লাইনে সেই একরুমের সারবদ্ধ কোয়ার্টারগুলো এখনও আছে ৷ এতগুলো বছর পরও সেই সরকারি কোয়ার্টারগুলোর দিকে তাকিয়ে শৈশবের অনেক কথা মনে করতে পারেন সুকুমার। মামা, মামী, দিদিমা আর দুই বছরের সাধন ৷ তাদের সাথে সুকুমারও এই প্রথম শহরবাসী ৷ মামা পুলিশ হিসাবে রেশনের উপর নির্ভরশীল ৷ মাঝে মাঝে অবশ্য পাবলিক রেশন তুলতেন ভোলা বাবুর কন্ট্রোল থেকে ৷ সেই তখন, কোয়ার্টারে অনেক বাঙালী আর অবাঙালী পুলিশ আর তাদের ছেলে মেয়ে যারা থাকতেন, তাদের নাম মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল সুকুমারের ৷ এখনও স্মৃতিতে সেইসব নাম বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি ৷ মনে সেই জীজ্ঞাসাও আছে, ওরা কে কোথায় এখন?

শহরের দালান কোঠা, গাড়ি ঘোড়া আর পাহাড় টিলা সব দেখে নেশার মতো লাগতো ৷ এতদিনে যেন নিজের জন্য সঠিক জায়গাটি খুঁজে পেয়েছেন তিনি ৷ জেনারেল হাসপাতালের পাহাড়ে উঠলে কত কি যে দেখা যেত ৷ গ্রামে যেখানে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি সেখানে গাড়ি ঘোড়া দেখা যেতো না ৷ সেখানে শুধু সাইকেল ছিল ৷ সেই সাইকেলকে তাঁরা, শিশুরা বলতেন ঠ্যাঙ গাড়ি ৷ তখন সেই একটা দুটো ঠ্যাঙ গাড়ি দেখেও নিজেদের অনেক সৌভাগ্যবান মনে হতো ৷ আর এই বড় শহরে এসে এই সমস্ত কলের গাড়ি আর হাল ফ্যাশানের গাড়ি দেখতে সুকুমারের খুবই ভালো লাগতো ৷ ছেলেবেলা থেকেই যন্ত্রের প্রতি তাঁর একটা গভীর ভালোবাসা ছিল। বাসা থেকে কিছুদূর এগিয়ে গেলে একটা চায়ের দোকান ছিল আর সেখানে ছিল বিরাট একটা রেডিও ৷ দোকানদার ওটাকে যখনই চালাত তখনই খই ফোটানোর মতো আওয়াজ বের হত ৷ সুকুমার তাই শুনতে যেতেন ৷ ওখানে তাঁর কাজ ছিল মামাতো ভাই সাধনকে নিয়ে খেলা আর পানি সংগ্রহ করা ৷ পিতলের চাবি ঘোরালেই কী জোরে কল থেকে পানি বের হবে যেন হাত ছিঁড়ে যাবে ৷ পানির কলের মালিকের নাম জসীমুদ্দিন ৷ মাঝে মাঝে কল পানি শূণ্য হত আর পানি নিতে আসা লোক হাঁক ছাড়ত, ওভাই জসীমুদ্দিন, কল ছোড়দো... ৷ অনেক উঁচুতে ছিল পানির টাংকি, সেখান থেকে পানি আসতো, তখন অবিরাম কয়লার রেল ইঞ্জিনের মতো শব্দ হতো ৷ পাতাল থেকে কলের দ্বারা পানি তুলে সেই পানি সিদ্ধ করে তবেই মাটির তলা দিয়ে সরবরাহ করা হতো ৷ দামপাড়া পানির কলের বর্তমান নাম 'ওয়াসা' ৷ দামপাড়ার সেই পানির কল দেখে সুকুমারের মনে একটি ধারণার জন্ম নিয়েছিল যে, বিদেশে চিঠি দিলে বুঝি মাটির তলা দিয়েই যায় ৷ শুধু তিনিই না, গ্রামের অনেকেই এমনটি ভাবতেন ৷

একজন শিশু শ্রমিকের কথা

১৯৫০ সালের ১ জুন ৷ চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ নালাপাড়ার বাবু মনোমহোন তালুকদার এর বাসা ৷ মাসিক তিন টাকা বেতনের চাকুরি নিলেন সুকুমার ৷ একটি পাঁচ মাসের শিশুকে সঙ্গ দেওয়া তাঁর প্রধান কাজ ৷ এই শিশুটি এখন চিত্র পরিচালক চঞ্চল বড়ুয়া (ঘর ভাঙা ঘর) ৷ এই পরিবারে এসে জীবনে প্রথম কিছুটা উন্নত শ্রেণীর রুচিশীল মানুষের সাথে পরিচয় হলো সুকুমারের ৷ এতোদিন যাদের আসেপাশে তিনি ছিলেন, তাঁরা সকাল আর রাতের খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতেন ৷ সেই জীবন থেকে শিল্প সাহিত্য অনেক দূরের বিষয় ছিল ৷ এই বাড়িটির কর্তাবাবুটি গম্ভীর প্রকৃতির হলেও বেশ স্নেহ প্রবণছিলেন ৷ গৃহকর্ত্রী মাসীমা এখনও জীবিত ৷ তিনি আপন সন্তানের চেয়ে সুকুমারকে কম ভালোবাসেন না ৷ শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা নাচ, গান, নাটক ইত্যাদি করে ৷ আপন ভাইবোনের মতো সম্পর্ক তাদের সাথে ৷ কেউই সুকুমারকে আলাদা চোখে, কাজের ছেলে হিসাবে দেখতেন না ৷
১৯৫২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে সুকুমার তাঁর এক মামাতো ভাইয়ের সাথে ভৈরব বাজার ছিলেন ৷ সেখানে বাবুর্চির কাজ করতে হতো ৷ দুজনের জন্য রান্না করার কাজ ৷ সুকুমারের মা তখন মামাবাড়িতে ৷ নিজেদের যে বাড়িঘর ছিল তাতো ১৯৪৩ সালের আকালে শেষ হয়ে গেছে ৷ চট্টগ্রামের চেয়ে এখানে এই রান্নার কাজে দুটাকা বেশি মাইনে পেতেন ৷ কিন্তু এই বেশি আয়ের চাকরির জন্য না, এখানে কাজ করার পেছনে ভিন্ন একটি উত্তেজনা কাজ করতো সুকুমারের ভেতর ৷ এখানে এসেই পেলেন দাদার সংগ্রহে রাখা 'দেব সাহিত্য কুটির' এর যতো মজার মজার শিশু সাহিত্য সংকলন ৷ তাড়াতাড়ি কাজ সেরে সেইসব পড়া শুরু করতেন ৷ সেগুলো সবই তিরিশ আর চল্লিশের দশকের ছিল ৷ অনেক লেখার শিরোনাম বহুদিন মনে ছিল সুকুমারের ৷ ঐ সময় আরেকটি আকর্ষণ ছিল সুকুমারের জীবনে ৷ সেটিও একটি পত্রিকা ৷ দৈনিক আজাদ এর 'মুকুলের মাহিফল' ৷ সারা সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা করে বসে থাকতেন তিনি ৷ এই সময়টা, এই অপেক্ষার প্রহরগোনা এই কিশোরটির জন্য অনেকখানি কঠিন ছিল ৷ আর পত্রিকাটি হাতে পাওয়ার মুহুর্তটিকে চরম মুহুর্ত বলে আখ্যায়িত করলেন সুকুমার ৷ কি ছিল সেদিনের সেই মুকুলের মাহিফলে ? অনেক অনেক মজার গল্প, ছড়া আর কাতুকুতু ৷ একজন শিশু শ্রমিকের একমাত্র বিনোদন ৷

এর ছমাস পর চট্টগ্রামের সেই পুরোনো বাসায় দেখা করতে গেলেন সুকুমার ৷ তাঁরা বললেন, ‌‌‍‌'পাঁচ টাকা মাইনে কি আমরা দিতে পারিনা ? তোর মা কেন পড়ানোর নামে ফাঁকি দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ? কোন স্কুলে, কোন ক্লাসে পড়ছিস ?' সুকুমার বললেন, 'গল্প কবিতার বই পড়েছি অ-নে-ক ৷' সবাই হেসে ফেলল ৷ সেই বাসায় তিনি আরো দুবছর ছিলেন ৷ সেটা ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৪ সাল ৷ এই বাড়িতেই কাজ করতে করতে এক কঠিন অসুখে পড়েন সুকুমার ৷ বাড়ির লোকের সেবা যত্নেই সুস্থ হয়ে উঠেন তিনি ৷ ঐসময়, ঐ অসুস্থতার সময়টুকু যখন কোন কাজ করতে হতো না সুকুমারের তখন তাঁর জীবনের প্রধান আকর্ষণ ছিল, সত্যযুগ আর যুগান্তর পত্রিকার ছোটদের পাততাড়ি, ছোটদের মজলিস ইত্যাদি ৷ যে কোন মূল্যে এগুলো তিনি পড়তেন ৷

পর্যাপ্ত বেতনের অভাবে সে বাসায় কাজ ছেড়ে দিয়ে এক চায়ের দোকানে তিনি কাজ নিয়েছিলেন ৷ সেখানে সাতটাকা করে দেওয়ার কথা ছিল ৷ দক্ষিণ নালাপাড়ার সুখেন্দু বিশ্বাস নামের সেই ব্যক্তির দোকানে ১৯৫৫ সালে ১০ মাস কাজ করেছিলেন তিনি ৷ কিন্তু দুই টাকা বাড়তি বেতনের চেয়ে আত্মরক্ষাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল সুকুমারের জীবনে ৷ সেখান থেকে পালালেন ৷ চলে এলন লালখান বাজারের নাছিম সওদাগর নামের এক ব্যক্তির হোটেলে ৷ এখানে টাকার পরিমাণও বেশি ৷ ১০টাকা মাইনের পাশাপাশি বাড়তি পাওয়া হিসাবে ভদ্রলোকের স্নেহটাকেও জয় করেছিলেন সুকুমার ৷ নাছিম সওদাগর আদর করে সুকুমারকে নোয়া মিয়া বা নোয়ইয়া বলে ডাকতেন ৷ দোকান যে খুব চলতো এমন নয় ৷ কিন্তু মাইনে পরিস্কার ছিল ৷ ১৯৫৬ সালে দৈনিক পৌনে দুটাকা বেতনে রাজমিস্ত্রীর কাজও করেছেন ৷ এছাড়া মাটি কাটার কাজ, লবনের গোলায় জোগালীর কাজও করেছেন ৷ এখনও লাললেনের জজসাহেব ইমাম হোসেনের বাড়ির দিকে তাকালে সেই স্মৃতি ভাসে সুকুমারের মনে ৷ সেখানেও দুদিন বালি তুলেছিলেন তিনি ৷ রোজ এক টাকা বারো আনা মুজুরীতে ৷

১৯৫৭ সালের দিকে সবকিছু ছেড়ে আবার সেই দক্ষিণ নালাপাড়ার পুরোনো বাসায় ফিরে এলেন ৷ তখন ওটা মেস হয়ে গেছে ৷ পাঁচ জনের জন্য রান্না করতে হয় ৷ খাওয়াসহ মাসিক মাথাপিছু তিন টাকা হারে ১৫ টাকা মাইনে পাওয়া যায় ৷ সকালে সবাইকে খাওয়ানো শেষে বিদায় দিয়ে একটি নেশায় মেতে উঠতেন তিনি ৷ সেটা বই পড়ার নেশা ৷ তখন অনেক আশ্চর্য সব বই পড়েছেন ৷ সঞ্চয়িতা, সঞ্চিতা, পথের পাঁচালী, কুলি, জনান্তিক আরও সব শিহরণ জাগানো বই ৷ এই সমস্ত বই, এর ভেতরকার জগত সুকুমারের ভেতরটাকে, তাঁর জীবনের অর্থটাকে বদলে দিচ্ছে সঙ্গোপনে ৷

প্রথম লেখা

দক্ষিণ নালপাড়ার পুরোনো মেস বাড়িতে কাজ করার সময় নিয়মিত চায়ের দোকানে যেতেন ৷ সেখানে যাওয়ার একমাত্র আকর্ষণ ছিল 'খেলাঘর' আর 'কচি কাঁচার আসর' পাঠ করা ৷ এই প্রচুর পাঠই একদিন তাঁকে সাহস জোগালো ৷ লিখতে বললো ৷ কেউ, কোন মানুষ না কিন্তু ৷ নিভৃতে অন্যদের লেখা-ই তাঁকে লিখতে বলল, উত্‍সাহ জোগালো ৷ লিখলেনও প্রথম কবিতা ৷ বৃষ্টি নিয়ে ৷ বৃষ্টি নেমে আয় ৷ প্রথম লেখাটি প্রকাশিত হয় 'খেলাঘর' এর পাতায় ৷ সেটা ৩ জুলাই, ১৯৫৮ সাল ৷ প্রথম লেখা প্রকাশের আনন্দকে অপার্থিব আনন্দ বলেছেন সুকুমার বড়ুয়া ৷ জ্যোত্‍স্না ফুলের মতো পবিত্র এক আনন্দ ৷ বাড়তি পাওয়া হিসাবে ছিল, এই লেখাটি পুরষ্কারও পায় ৷ ৩য় পুরস্কার ৷ ১ম হয়েছিল নাজমা জেসমিন, ২য় ইমরুল চৌধুরী ৷

আবার জীবন যুদ্ধ

দক্ষিণ নালপাড়ার পুরোনো মেস বাড়ির ১৫ টাকা বেতনে আর চলছিল না ৷ মাকে টাকা পাঠালে বাকি টাকা দিয়ে নিজের চলা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে ৷ সেই কাজ ছেড়ে ১৯৫৯ সালে কিছুদিন ফলমূল বিক্রি করলেন ৷ এরপর আইসক্রিম, বুট বাদাম ইত্যাদি বিক্রি করেও রোজগার বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন ৷ লালদিঘির পাড় থেকে শুরু করে উজারা সিনেমা হল পর্যন্ত অনেক কিছু ফেরি করে বিক্রি করে বেড়িয়েছেন সুকুমার ৷ অবস্থাসম্পন্ন বড় বড় আত্মীয়রা দূর থেকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন ৷ অনেকে আক্ষেপও করেছেন ৷ দানিয়ালাপাড়ায় মাসিক পাঁচটাকায় বাসা ভাড়া করে মাকে নিয়ে আসলেন তিনি ৷ অনেকদিনপর আবার মায়ের সাথে থাকা শুরু হল ৷ কিন্তু রোজগার আর খরচের তারতম্যের কারণে জীবন প্রায় থেমে যায় যায় করছে ৷ মেসে থাকতে ঢাকার পত্রিকায় ছয় সাতটি লেখা বেরিয়েছিল ৷ এখন কিন্তু লেখালেখি নিয়ে ভাবার অবকাশও নেই ৷
বছর খানিক এভাবে কাটলো ৷ এরপর মাকে আবার মামা বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন ৷ আর নিজে ফিরে গেলেন সেই পুরোনা মেসে ৷ আগের বেতনেই ৷ এখানে একটা সান্ত্বনা আছে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখি করার সুযোগটা পাওয়া যায় ৷ এরমধ্যে দৈনিক জামানা পত্রিকায় একটা দীর্ঘ লেখা নিয়ে গেলেন তিনি ৷ নাম, পথের ধূলো ৷ করুণ কবিতা ৷ কবিতাটি জসীম উদ্দীন এর ‌'কবর' কবিতা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা ৷ এই কবিতাও পড়ার সুযোগ হয়েছিল মেসেই ৷ মেসের নৈশ কলেজ ছাত্র সংসদ সদস্য বিমল বাবুর পাঠ্যবইয়ে ৷ সাহিত্যিক মাহবুব-উল-আলম সাহেব বললেন, তোমার কথা আমি শুনেছি ৷ তুমি যখন কাজ করবে, তখন ভাববে তুমি একজন বাবুর্চি ৷ আর যখন লিখতে বসবে, তখন ভাববে, তুমি সত্যিই একজন কবি ৷ পৃথিবীর সব কবির মতো ৷

রাজধানীর বুকে

এরমধ্যেই ঢাকায় আসার জন্য মন তৈরী হয়ে গেছে ৷ মন বলছে, এখানে থাকলে আসলে কিছুই হবেনা ৷ কিন্তু জীবনে উপার্জন আর সুনাম দুটোরই দরকার আছে ৷ তাই মিথ্যে বলতে হলো ৷ মেসের কর্মকর্তাদের একদিন বললেন, 'আমি এক ছাপাখানায় প্রশিক্ষণের কাজ পেয়েছি ৷' কবি হয়ে বাবুর্চিগিরি যেমন পোষায় না তেমনি মানায়ও না ৷ বড় ভাইয়ের মতো স্নেহপ্রবণ সবাই সুকুমারকে মুক্তি দিতে রাজি হলেন ৷
মহানন্দে সাতটাকা দশ আনার টিকিট কেটে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন সুকুমার বড়ুয়া ৷

ঢাকায় এসে মন্দির খুঁজতে গিয়ে পেলেন দাদাভাইকে, ইত্তেফাক অফিসে ৷ তারপরে বাবু দেবপ্রিয় বড়ুয়ার (অবসরপ্রাপ্ত বাসস প্রধান) সাথে পরিচয় হল ৷ তোপখানা রোডে তাঁরা সাতজন মেস ভাড়া করেছেন ৷ কাজের লোক দরকার ৷ আবারও চাকরি মিলে গেল ৷ মাথাপিছু পাঁচটাকা করে সাতজনের জন্য পঁয়ত্রিশ টাকা মাইনের চাকরি ৷ চাকরিতো হলো কিন্তু লেখা আর হয়না ৷ তবুও অনেক কষ্ট করে লিখলেন 'ছারপোকার গান' আর 'খাওয়ার গান' শিরোনামের দুটি লেখা ৷

১৯৬১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ৷ মাকে হারিয়ে একদম একা হয়ে পড়লেন সুকুমার বড়ুয়া ৷

১৯৬২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চৌষট্টি টাকা বেতনের চাকুরী হয় সুকুমারের ৷ ১৯৬৩ সালে তোপখানা রোডে ছয়টাকায় বেড়ার ঘর ভাড়া করে এই প্রথম স্বাধীনভাবে প্রচুর লেখালেখি শুরু করেন। কচিকাঁচার আসর, খেলাঘর আর মুকুলের মাহফিলে এসমস্ত লেখা ছাপা হতে থাকে ৷ যদিও তিনি নিজে মনে করেন যে সেসব লেখায় সুনির্মল বসুর পরোক্ষ প্রভাব থাকলেও থাকতে পারে ৷ তারপরও সে লেখাগুলো এখনো সুখপাঠ্য তাঁর কাছে ৷

সৃষ্টিশীল আড্ডার গল্প

১৯৬৬ সালে ঢাকার পল্টন ময়দানে রোজ আড্ডা জমাতেন সুকুমাররা ৷ সে আড্ডায় হাজির থাকতেন আখতার হুসেন, রশীদ সিনহা, মাহমুদউল্লাহ, শফিক পান্না, মোহাম্মদ মোস্তফা, আলী ইমামসহ আরও অনেকে ৷ এঁদের রাজনৈতিক লেখাগুলো দারুণভাবে নাড়া দিত সুকুমারকে ৷ ফলে তাঁর লেখায়ও পরিবর্তন আসে ৷ আক্ষেপ কিন্তু আছেই ৷ প্রথম দিককার সাতটি বইয়ের একটাও আজ আর বাজারে নেই ৷ বাংলাদেশের অনেক প্রবীণ লেখকেরই এই সমস্যা আছে ৷ দেশের বহু মানুষই হয়তো এই সমস্ত মানুষের নাম জানেন কিন্তু তাঁদের লেখা পড়ার সৌভাগ্য আর তাদের হয়না ৷ সুকুমার রায়ের মতো ৮০ বছর অবিরাম পুনঃমুদ্রণের সৌভাগ্য বাংলাদেশের কোন লেখকের কি হবেনা ?

সুকুমার বড়ুয়ার লেখালেখির জগত্‍

সুকুমার বড়ুয়া তাঁর নিজের লেখালেখি নিয়ে যা বলেছেন সেটি আমরা তাঁর মুখ থেকেই শুনি ৷
আমি কেমন করে ছড়ার জগতে প্রবেশ করলাম, সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় ৷ ছেলেবেলায় মনসার পুঁথি শোনার সময় পাঠক-প্রধানের মুখে শুনতাম, তোমার গান তুমি গাইবা উপলক্ষ্য আমি/ অশুদ্ধ হইলে মাগো লজ্জা পাবা তুমি ৷ এক অদৃশ্য দৈবসত্তার ওপর নির্ভরতা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতেও প্রচুর দেখতে পাই ৷ আমার কৃতিত্ব দেখে অনেক সাধারণ পাঠক বলেন, এটা ঐশ্বরিক দান, জন্মান্তরের কর্মফল ইত্যাদি ইত্যাদি ৷ এসব আমার মস্তিস্কে খুব একটা ক্রিয়া করেনা ৷ সব বুঝিও না ৷

আমি রাউজান থানার বিনাজুরি গ্রামে যেখানে জন্ম নিয়েছিলাম সেখানে শিল্প সংস্কৃতি দূরে থাক, নিম্নতম লেখাপড়ার চর্চাও খুব একটা ছিলনা ৷ তাই বলে চট্টগ্রাম তথা বাংরার লোক-ঐতিহ্যের অবদান লোকজ ছড়া বা শ্লোকের কোনো অভাব ছিলনা ৷ দলবদ্ধ গ্রাম্য শিশুদের রোদ ডাকা, বৃষ্টি থামানো, হা-ডু-ডু খেলা, চি বুড়ি খেলা, ধাঁধাঁ বা হেঁয়ালী ইত্যাদি ছাড়াও ছন্দে ছন্দে ভাব প্রকাশের মাধ্যমগুলো আমাকে আলোড়িত করতো ৷

১৯৪৪-৪৫ সনের দিকে যখন আমার বড়দিদির বাড়িতে অবস্থান করছিলাম, সেই ইদিলপুর আমাদের পাশ্ববর্তী গ্রাম ৷ সে গ্রাম বৌদ্ধদের জন্য নিষিদ্ধ হলেও কিছু লোক সারা রাত জেগে মনসার পুঁথি পাঠ করতো ৷ দলবদ্ধ নর নারী সেই ছন্দে কাহিনীর যাদুতে মুগ্ধ হয়ে যেতো ৷ আমি তো নাবালক শিশু ৷ আমি আরও বেশি মুগ্ধ হতাম ৷ কিছু বাস্তব কারণে আমাকে যদিও খুব লাজুক বা মুখচোরা হয়ে থাকতে হতো, তবুও খেলাধূলা বা ছুটোছুটির সময় কিংবা পথে একা চলার সময়, সেই পুঁথির ধূয়া ঘোষা বা কোরাসগুলো জোরে জোরে গাইতে গাইতে অন্য জগতে চলে যেতাম ৷ তখন ঐ অঞ্চলে ভেলুয়ার পুঁথি, মনসার পুঁথি, বিশেষ ঘটনার কবিতা ইত্যাদি খুব জনপ্রিয় ছিল ৷

এরও আগে মামা বাড়িতে অবস্থানকালে আমি যোগীন্দ্রনাথ এর হাসিখুশি পুরোটাই মুখস্থ করেছিলাম ৷ দিদির বাড়িতে অনেকেই ঘিরে ধরতো সেই বর্ণমালার ছড়াগুলো মুখস্থ শোনার জন্য ৷ আশ্চর্যের ব্যাপার এই, ৫০ বছর পরও আমার ঢাকার আবাসিক এলাকার ছেলে মেয়েরা টিভি অনুষ্ঠানের চাইতেও আমার মুখের ছড়া বেশি পছন্দ করে বলে মনে হয় ৷

নিজের লেখার মূল্যায়ন

১৯৫৮ থেকে ২০০৭ প্রায় পঞ্চাশ বছরে যে পরিমাণ লেখার কথা, তার নিম্নতম অংশও বোধহয় লিখতে পারিনি ৷ তবে লেখার অভ্যাসটা একেবারে বাদও দেইনি ৷ ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত প্রচুর লিখেছি ৷ এ লেখাগুলো প্রথম দিকে সুনির্মল বসু প্রভাবিত এবং শেষদিকে দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রভাবিত বলা যায় ৷ পরবর্তীতে স্বাতন্ত্রের সন্ধান করতে গিয়ে লেখার পরিমাণ খুব কমে যায় ৷
লেখার জন্য আমি অকল্পনীয় প্রশংসা ও স্বীকৃতি পেয়েছি ৷ শুধু ছড়ার জগতে আবদ্ধ থেকে কেউ এত বেশী পেয়েছেন বলে আমার মনে হয়না ৷ শিক্ষাগত অপূর্ণতা এবং আর্থিক অনিশ্চয়তা নানাভাবে আমার মানসিক দুর্বলতার কারণ ৷ এতদসত্ত্বেও আমি শিশু কিশোরদের নির্মল আনন্দ দেবার চেষ্টা করেছি ৷

সুকুমারের সংসার জীবন ও একটি স্বপ্ন

সুকুমার বড়ুয়া বিয়ে করেছিলেন ২১ এপ্রিল ১৯৬৪ সালে ৷ পাত্রী ছিলেন ননী বালা বড়ুয়া ৷ চট্টগ্রামের গহিরা গ্রামের এক বিশিষ্ট শিক্ষক প্রতাপ চন্দ্র বড়ুয়ার মেয়ে ৷ সুকুমার বড়ুয়া চার সন্তানের জনক ৷ তিন মেয়ে ও এক ছেলে ৷ মেয়েরা হচ্ছেন চন্দনা বড়ুয়া, রঞ্জনা বড়ুয়া ও অঞ্জনা বড়ুয়া ৷ ছেলে অরূপ রতন বড়ুয়া ৷ চন্দনা বিবাহিতা ৷ ছেলে চাকুরিরত ৷ অন্যেরা পড়াশোনা করছেন ৷ পরিবারের সকল সদস্যদের নিয়ে সুকুমার বড়ুয়া বর্তমানে বাস করছেন আজিমপুরে তিন কামরার একটি ভাড়া করা বাসাতে ৷ এখন তাঁর অধিকাংশ সময় কাটে নিজের লেখাগুলিকে সংরক্ষণ করার চিন্তায় ৷ আরও একটি বড় স্বপ্ন তিনি আজীবন বুকের ভেতর লালন করছেন ৷ সেটি চট্টগ্রামে সুকুমারের পৈতৃক ভিটায় সুকুমার শিশু তীর্থ নামে একটি শিশু পাঠাগার স্থাপন করা ৷ এই পাঠাগারটি স্থাপন করার জন্য তিনি সামাজের সকলের কাছে আবেদন জানালেন ৷ তাঁর প্রবল ইচ্ছা, ইহকালে থাকাকালীন এই পাঠাগারের কাজ শেষ করা ৷

সুকুমার বড়ুয়ার যত বই

পাগলা ঘোড়া
প্রকাশকাল : ১৯৭০
পরিবেশনকারী : বাংলা একাডেমী
ভিজে বেড়াল
প্রকাশকাল : ১৯৭৬
পরিবেশনকারী : মুক্তধারা

চন্দনা রঞ্জনার ছড়া
প্রকাশকাল : ১৯৭৯
পরিবেশনকারী : মুক্তধারা

এলোপাতাড়ি
প্রকাশকাল : ১৯৮০
পরিবেশনকারী : বাংলা একাডেমী

নানা রঙের দিন
প্রকাশকাল : ১৯৮১
পরিবেশনকারী : শিশু একাডেমী

সুকুমার বড়ুয়ার ১০১টি ছড়া
প্রকাশকাল : ১৯৯১
পরিবেশনকারী : বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র

চিচিং ফাঁক
প্রকাশকাল : ১৯৯২
পরিবেশনকারী : ওলট পালট প্রকাশনী

কিছু না কিছু
প্রকাশকাল : ১৯৯৫
পরিবেশনকারী : বিশাখা প্রকাশনী

প্রিয় ছড়া শতক
প্রকাশকাল : ১৯৯৭
পরিবেশনকারী : মিডিয়া

বুদ্ধ চর্চা বিষয়ক ছড়া
প্রকাশকাল : ১৯৯৭
পরিবেশনকারী : সৌগতঃ ভিক্ষু সুনন্দ প্রিয়

ঠুস্ঠাস্
প্রকাশকাল : ১৯৯৮
পরিবেশনকারী : প্রজাপতি প্রকাশন

নদীর খেলা
প্রকাশকাল : ১৯৯৯
পরিবেশনকারী : শিশু একাডেমী

আরো আছে
প্রকাশকাল : ২০০৩
পরিবেশনকারী : আরো প্রকাশন

ছড়া সমগ্র
প্রকাশকাল : ২০০৩
পরিবেশনকারী : সাহিত্যিকা

ঠিক আছে ঠিক আছে
প্রকাশকাল : ২০০৬
পরিবেশনকারী : প্রবাস প্রকাশনী, লন্ডন

কোয়াল খাইয়ে
প্রকাশকাল : ২০০৬
পরিবেশনকারী : বলাকা, চট্টগ্রাম

সুকুমারের জীবনে যত স্বীকৃতি

বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার : ১৯৭৭
ঢালী মনোয়ার স্মৃতি পুরস্কার : ১৯৯২
বৌদ্ধ একাডেমী পুরস্কার : ১৯৯৪
বাংলাদেশ শিশু একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার : ১৯৯৭
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধ ছাত্র সংসদ সম্মাননা : ১৯৯৭
অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য সম্মাননা : ১৯৯৭
আলাওল শিশু সাহিত্য পুরস্কার : ১৯৯৯
চোখ সাহিত্য পুরস্কার, ভারত : ১৯৯৯
নন্দিনী শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব (শিশু সাহিত্য) : ২০০০
আইরিন আফসানা ছড়া পদক : ২০০২
স্বরকল্পন কবি সম্মাননা পদক : ২০০৪
শিরি এ্যাওয়ার্ড : ২০০৫
শব্দপাঠ পদক : ২০০৬
বৌদ্ধ সমিতি যুব সম্মাননা : ২০০৬
অবসর সাহিত্য পুরস্কার : ২০০৬
মোহাম্মদ মোদাব্বের হোসেন আরা স্মৃতি পুরস্কার : ২০০৭

তথ্য সূত্র

সুকুমার বড়ুয়া, উত্তম বড়ুয়া, অরূপ রতন বড়ুয়া, রঞ্জনা বড়ুয়া, রাশেদ রউফ, নাওশেবা সবিহ্ কবিতা, চারুলতা, ভোরের কাগজের ইষ্টু কুটুম বিভাগ, টইটুম্বুর, জোবাইর হোসাইন সিকদার, স্বপন কুমার বড়ুয়া, নজরুল ইসলাম নঈম, তপন বাগচী, মাশরুফা মিশু, আলী আজম, শফিকুল আলম টিটন, সবুজের মেলা প্রমুখ ৷

No comments: