মাহমুদুল হক Mahmudul Haque Biography 1940-2008
"আমার লাইফটা একটু অন্যরকম৷ যেমন, আমরা দশ ভাইবোন৷ ছয় ভাই ও চার বোন৷ বাবা চাকরি করেন৷ বাবার চাকরির ওপর আমরা নির্ভরশীল৷ আমার একটা ভয় ছিল সবসময়৷ বাবা যদি ফট করে মারা যান, তখন আমাদের কী হবে? আমার বড় ভাই চিটাগংয়ে চাকরি নিয়ে চলে গেছেন৷ মেঝো ভাই সিনেমায়৷ থার্ড ভাই বাড়িতে থাকেন না৷ আমি ফোর্থ ভাই৷ আমিও বাড়িতে থাকি না৷ আমার মা একদিন বললেন, 'তোর বাবা রাতে ঘুমান না৷ ছাদে পায়চারি করেন৷' আমি একদিন ছাদে উঠে গিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'তুমি নাকি রাতে ঘুমাও না, কেন ঘুমাও না?' তিনি পায়চারি করতে করতেই বললেন, 'তা জেনে তোমার কী? তোমার কী?' ধমক খেয়ে চুপ করে গেলাম৷ মায়ের ঘরে ফিরে গিয়ে দেখি মা কাঁদছেন৷ আমি আবার ছাদে উঠে গিয়ে বাবার সাথে চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম৷ বাবা তখন বললেন, 'দেখ, আমার চারটে মেয়ে আছে, তোমরা আছ, আমি যদি মারা যাই তোমাদের কী হবে? এ চিন্তায় আমার ঘুম আসে না৷' বলে বাবা কেঁদে ফেললেন৷ তাঁর যে শারীরিক অসুবিধা দেখা দিয়েছে তা কিন্তু বললেন না৷ বাবাকে এই প্রথম আমি কাঁদতে দেখলাম৷ আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল৷ পরদিন থেকেই আমি কাজের খোঁজ শুরু করলাম৷ খোঁজ, খোঁজ আর খোঁজ৷"
এই কথাগুলো আমাদের কথাসাহিত্যের বিরল ব্যতিক্রম ব্যক্তিত্ব মাহমুদুল হকের৷ ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরের এক সকালে জিগাতলার বাসায় বসে আমার কাছে তাঁর অন্যরকম জীবনের গল্প শুরু করেছিলেন তিনি৷ সেই গল্পে দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা৷ সেদিন যেমন গল্পে গল্পে খুব দ্রুত সন্ধ্যা নেমেছিল, তেমনি ২০০৮ সালের ২১ জুলাই দ্রুত মহাসন্ধ্যা নামল মাহমুদুল হকের জীবনেও৷ মাহমুদুল হকের এই জীবনসন্ধ্যা তাঁকে নিয়ে গেছে দূরে এক অপার অন্ধকার যবনিকার আড়ালে৷ মাত্র ৬৭ বছরের জীবন যাপন শেষে না বলা অনেক গল্প নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে তিনি চলে গেছেন৷
If you cannot view the fonts properly please download and Install this file.
কাজ অনেক করেছেন মাহমুদুল হক৷ সংবাদে চাকরি করেছেন৷ সংবাদের চাকরি দিয়েই পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন৷ তিন মাসেই ছেড়ে দেন সে কাজ৷ অনুবাদের কাজ করা তাঁর কাছে খুব বাজে ও কঠিন মনে হয়৷ তাছাড়া চাকরি করে সংসার চালানো আরও কঠিন৷ বাবাকে দেখেই তিনি তা বুঝেছেন৷ শুরু হল ব্যবসার চিন্তা৷ ব্যবসার চিন্তা থেকেই শুরু করলেন বল-বেয়ারিংয়ের দোকানে বসা৷ আর বল-বেয়ারিংয়ের দোকানে বসে আড্ডা মারতে মারতেই ব্যবসা শেখা৷ যে দোকানে বসে থাকেন সেই দোকানে ক্রেতা এসে কোনো একটা জিনিস চেয়ে না পেলে তিনি সেটা অন্য কোনো দোকান থেকে খুঁজে এনে দিতেন৷ এতে করে ক্রেতা ও বিক্রেতা- দুজনের দিক থেকেই কিছু পেতেন৷ কিন্তু কয়েক দিনেই মনে হল- এ ব্যবসায় সুবিধা করা যাবে না৷ আগাখানীরা এ ব্যবসায় একেবারে জেঁকে বসে আছে৷ এবার আড্ডা শুরু করলেন ইসলামপুরের সোনার দোকানগুলোতে৷ সোনার দোকানগুলোতে আড্ডা মারতে গিয়েই একদিন আকস্মিকভাবে নাইজেরীয় পরিব্রাজক মাসুদ ওলাবিসি হাজালার সঙ্গে পরিচয়৷ ১১ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মাসুদ৷ যেখানেই যান, সেখানেই কোনো না কোনো কাজ করেন মাসুদ৷ বাংলাদেশে (তখন পূর্ব পাকিসত্মান) এসে তিনি কাজ করেছেন ডেইলি অবজারভারে৷ এ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে একটা স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন৷ দোকানে দোকানে ঘুরে তেমন একটা স্মৃতিচিহ্ন বানিয়ে দেওয়ার কথা বলছিলেন তিনি৷ কিন্তু কেউ তার কথা বুঝতে পারছিল না৷ ঘুরতে ঘুরতে এলেন একটা ছোট্ট দোকানে৷ মাহমুদুল হক এই দোকানে বসে আড্ডা মারছিলেন৷ মাসুদের কথা শুনে এগিয়ে গেলেন মাহমুদুল হক৷ তার মনমতো চার্ম বানিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিলেন৷ বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক হাতে, গলায় ও কোমরে তাবিজ পড়ে৷ বাঙালি সংস্কৃতির চিহ্ন হিসেবে ছোটবড় অনেকগুলো তাবিজ একটা চেইনে বেঁধে হাতে পড়ার একটা চার্ম বানিয়ে দিলেন মাহমুদুল হক৷ মাহমুদুল হকের এই সৃজনশীলতা দেখেই বন্ধু দোকানি বললেন, "দোস্ত, তুই এক কাজ কর৷ অবসর পেলেই তুই আমার দোকানে এসে বসবি৷ এজন্য আমি তোকে কিছু টাকাপয়সাও দেব৷"
এই সোনার দোকানে বসতে বসতেই মাহমুদুল হক বুঝে গেলেন অলঙ্কারের ব্যবসার সবকিছু৷ বুঝে গেলেন এ ব্যবসা করতে তেমন কোন টাকা লাগে না৷ আগ্রহী হয়ে উঠলেন এ ব্যবসায়৷ বাবাকে বলে-কয়ে রাজি করালেন৷ বাবা জমি বিক্রি করে কিছু টাকা দিলেন৷ আরও কিছু টাকা জোগাড় করে মোট ১৪ হাজার টাকা নিয়ে বায়তুল মোকাররমে একটা দোকান নিলেন৷ মাত্র ১৮ ভরি সোনা দিয়ে শুরু করলেন দোকান৷ ১৯৭১ সালের মার্চে এই দোকান লুট হয়৷ ঢাকা শহরে তখন মাহমুদুল হকদের 'তাসমেন জুয়েলার্স'র ব্যাপক খ্যাতি ছিল৷ শুরু করেছিলেন ১৮ ভরি দিয়ে, ১৯৭১ সালে সেই দোকানে সোনা ছিল ১ হাজার ৮০০ ভরি৷
এই হচ্ছেন জহুরি মাহমুদুল হক৷ তাঁকে যারা চিনতেন তারা জানেন, ঢাকায় দামি পাথর ও মূল্যবান ধাতু চেনা হাতেগোনা কয়েকজনের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম৷
খুব ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি শুরু করেছিলেন মাহমুদুল হক৷ বাবার চাকরির সূত্রে ঢাকার আজিমপুর কলোনিতে থাকার সময় পরিচয় হয়েছিল কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর সঙ্গে৷ পাশাপাশি দুটি বাড়িতে থাকতেন তাঁরা৷ মাহফুজউল্লাহই মাহমুদুল হকের দেখা প্রথম লেখক৷ মাহফুজউল্লাহ বয়সে ছিলেন তাঁর চেয়ে বড়৷ পড়তেন উচ্চ মাধ্যমিকে৷ হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিল আর লিখতেন একবারে৷ কোনো কাটাকুটি থাকত না সে লেখায়৷ মাহফুজউল্লাহর কাছে সবাই আসত৷ তখনই তিনি রীতিমতো বিখ্যাত৷ তখন কবিদের মধ্যে ফররুখ আহমদ শ্রেষ্ঠ৷ আর এই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদারদের দলটা ছিল মাহফুজউল্লাহর৷ খুব আদর করতেন মাহমুদুল হককে৷ মাহমুদুল হক তখনও নিম্ন মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হননি৷ কোন একটা লেখা হলেই গিয়ে দেখাতেন মাহফুজইল্লাহকে৷ মাহফুজউল্লাহই মাহমুদুল হকের প্রথম লেখাটি নিয়ে যান 'সৈনিক' নামের একটি পত্রিকার জন্য৷ অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই মাহমুদুল হক রীতিমতো লেখক৷ গল্প লিখতেন 'মাহে নও' নামের সরকারি পত্রিকায়৷ ছান্দসিক কবি আবদুল কাদির ছিলেন ওই পত্রিকার সম্পাদক৷
মাহমুদুল হকের লেখার মান উন্নয়নে প্রথম দিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন কবি শহীদ কাদরী৷ লিখিয়ে বন্ধুদের কাছে ও বাড়ির সবার কাছে মাহমুদুল হক পরিচিত ছিলেন 'বটু' নামে৷ তখন তাদের আড্ডা হত রেসকোর্সে৷ সোনার দোকান বন্ধ করে রেসকোর্সে চলে আসতেন তিনি৷ রাত দশটা পর্যন্ত সেখানে আড্ডা চলত৷ দশটার পর রেসকোর্সের গেট বন্ধ হয়ে যেত৷ তখন অনেকেই চলে যেত৷ একদিনের কথা৷ রেসকোর্সের আড্ডা শেষে পাশাপাশি হাঁটছিলেন শহীদ কাদরী আর মাহমুদুল হক৷ সেদিনের আড্ডায় শহীদ কাদরীর 'অগ্রজের উত্তর' কবিতার প্রশংসা করেছিল সবাই৷ অথচ শহীদ কাদরীর সেই কবিতা ও মাহমুদুল হকের গল্প 'কন্ঠস্বরের চিত্র' প্রকাশিত হয়েছিল একটি পত্রিকার একই সংখ্যায়৷ সবাই কাদরীর কবিতার প্রশংসা করল, কেউ তাঁর গল্পের কথা কিছু বলল না৷ এসব ভাবতে ভাবতে কাদরীর পাশে মনমরা হয়ে হাঁটছিলেন মাহমুদুল হক৷ বুঝতে পেরে কাদরী তাঁকে বললেন, 'কী রে বটু, তুই কি কিছু বলবি?' প্রশ্ন শুনে আরও মনমরা হয়ে গেলেন মাহমুদুল হক৷ একেবারে চুপসে গিয়ে বললেন, 'না!' শহীদ কাদরী এবার খুলেই বললেন, 'অনেক ক্ষণ ধরেই তো উসখুস করছিস বলার জন্য৷ তোর গল্প সম্পর্কে কিছু বলতে চাস?' এবার মাহমুদুল হক বললেন, 'হ্যাঁ৷' মাহমুদুল হক ভেবেছিলেন, কাদরী তাঁর গল্পের প্রশংসা করবেন৷ কিন্তু কাদরী তখন দাঁতমুখ খিঁচিয়ে, খিস্তি মিশিয়ে শুরু করলেন, 'কী গল্প লিখিস! এত অলঙ্কার! গয়নাগাটি পরিয়ে লেখাকে একদম ভারী করে রাখিস৷ সব গয়নাগাটি খুলে ফেল, নেংটা করে ফেল, একদম নেংটা করে দে!' শহীদ কাদরীর এই কথায় চোখ খুলে যায় মাহমুদুল হকের৷ লেখার নিজের ত্রুটির জায়গাটা আবিষ্কার করতে পারেন তিনি৷ এরপর থেকেই তাঁর লেখা সবার নজর কাড়তে থাকে৷
কথাসাহিত্যেও কিন্তু মাহমুদুল হক ছিলেন একই রকম পাকা জহুরি৷ বাংলাদেশের সমাজের এমন কিছু চরিত্র তিনি তুলে এনেছেন, এমন কিছু চরিত্র তিনি অলঙ্কার গড়ার মতোই সুক্ষ্ম চারুতায় গড়ে তুলেছেন যা আর কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি৷ সোনা, রূপা, হীরা, জহরত, মণি, মুক্তা চিনতে মাহমুদুল হকের যেমন খুব একটা সময় লাগত না, তেমনি 'জীবন আমার বোন'-এর রঞ্জু, খোকা, নীলাভাবি, 'অনুর পাঠশালা'-এর অনু, 'নিরাপদ তন্দ্রা'র হিরণ, ইদ্রিস কম্পোজিটর, কাঞ্চন, 'কালো বরফ'-এর আবদুল খালেক, রেখা, নরহরি ডাক্তার কিংবা 'প্রতিদিন একটি রুমাল' গল্পগ্রন্থ ও অগ্রন্থিত শতাধিক গল্পের শত শত চরিত্রকে চিনে নিতে বা গড়ে নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি৷ শুধু চরিত্র নয়, যে শব্দ দিয়ে গড়ে তোলা হয় গল্প-উপন্যাস সেই শব্দ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মুক্তোদানা বেছে নেওয়ার দক্ষতা দেখিয়েছেন তিনি৷ মুক্তোদানার মতো সব জ্বলজ্বলে শব্দে গেঁথেছেন গদ্যের অপূর্ব মালা৷ খুব দ্রুত সুনিপুণ গদ্যে লিখেছেন গল্প-উপন্যাস৷ এ ব্যাপারে একজন দক্ষ কারিগরের মতো তিনিও বলেছেন, "লেখালেখি তো কোনো কাজই না৷ আমার বেশীর ভাগ লেখা লিখতে সাত থেকে আট দিন লেগেছে বড়জোর৷ যে কারণে অধিকাংশ লেখাই সংক্ষিপ্ত৷ মাত্র তিনটি লেখা (উপন্যাস) আমি ঘরে বসে লিখেছি৷ 'জীবন আমার বোন', 'নিরাপদ তন্দ্রা' আর 'অনুর পাঠাশালা'৷ বাকিগুলো (খেলাঘর, মাটির জাহাজ, কালো বরফ, অশরীরী, পাতালপুরী) সব দোকানে বসে লেখা৷"
মানুষ চেনার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল মাহমুদুল হকের৷ এই ক্ষমতা না থাকলে গল্প-উপন্যাস লেখা যায় না৷ এই ক্ষমতার বলেই তাঁর পক্ষে গল্প-উপন্যাসে এত বিচিত্র চরিত্র চিত্রণ সম্ভব হয়েছে৷ তিনি মানুষ চেনার এই ক্ষমতা পেয়েছিলেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে৷ তাঁর মায়ের নাম ছিল মাহমুদা, আর তাঁর নাম মাহমুদুল হক৷ ১৯৫৭ সালের দিকে তাঁরা ঢাকেশ্বরীর দিকে থাকতেন৷ তাঁর মায়ের কাছে যারা আসত, তারা সবাই ছিল হিন্দু মহিলা৷ হিন্দু মানে কি, খান্দানি হিন্দু৷ তাঁদের বাড়ির চারপাশে ছিল হিন্দু পরিবার৷ চারটে মহিলা আসত যারা মুসলমান৷ এই মুসলমান মহিলাদের মধ্যে একবার এক মহিলা একটা মেয়েকে নিয়ে এলেন তাঁর মায়ের কাছে৷ তাঁর মা কিন্তু আগে থেকে কিছুই জানতেন না৷ অত মনযোগ দিয়ে মেয়েটিকে লক্ষ্যও করেননি৷ কিন্তু পরে ওই মহিলা তাঁর মাকে বললেন, 'ওই দিন যে মেয়েকে নিয়ে এলাম, মেয়েটা কেমন?' উত্তরে তিনি প্রথমে বললেন, 'ভালোই তো!' কিন্তু, পরে মহিলা যখন বুঝিয়ে বললেন, তখন তিনি শুধু বললেন, 'না, ওখানে ছেলেকে বিয়ে করিও না৷' কেন নয়? কী ঘটনা? ওসব বলাবলি নাই৷ তিনি শুধু আপত্তি করে 'না' বলে দিলেন৷ তাঁর মায়ের কথা অমান্য করে ছেলেকে বিয়ে করিয়েছিলেন ওই মহিলা৷ অসম্ভব সুন্দরী মেয়ে, তাই লোভ সামলাতে পারেননি৷ কিন্তু এক বছরের মাথায় মেয়েটার স্বামী মারা গেল৷ তাঁর মায়ের মানুষ পড়ার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল৷ তাঁর কাছ থেকেই এই গুণ তিনি পেয়েছিলেন৷
মাহমুদুল হকের লেখায় স্থান পাওয়া বিচিত্র মানুষদের অধিকাংশের একটা জায়গায় মিল আছে৷ সেটা হচ্ছে-তাঁর চরিত্রগুলো প্রায় একই রকম৷ সবাই যেন উন্মূল৷ কোথাও কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না৷...এর কোনো ব্যাখ্যা নেই৷ ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারতেন৷ কিন্তু তিনি ইচ্ছা করে দেননি৷ কারণ তাঁরা আসলেই উন্মূল৷ এটা কিন্তু সত্যি কথাই যে, প্রত্যেকটি চরিত্র নিজ থেকে উন্মূল৷ আসলেই তিনি মনে করেন, মানুষ উন্মূল, এটা হতে পারে৷ মাহমুদুল হক নিজেও কিন্তু এক উন্মূল মানুষ৷ তাঁর জন্ম ১৯৪০ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে৷ ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মাহমুদুল হকের বাবা বাংলাদেশে (তখন পূর্ব পাকিস্তান) চলে আসেন৷ বাবার সরকারি চাকুরির সুবাদে ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় আজিমপুর কলোনিতে ওঠেন তাঁরা৷ দেশভাগ মাহমুদুল হককে উন্মূল করেছিল৷ তিনি নিজেও নিজেকে উন্মূল করেছিলেন৷ ১৯৮২ সালের দিকে চলে গিয়েছিলেন লেখালেখির বাইরে৷ শুধু লেখালেখি নয় জাগতিক সব কামনা-বাসনা ও প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি থেকেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি৷
নিজের লেখা নিয়ে মাহমুদুল হকের কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না৷ অথচ, তাঁর লেখার ব্যাপারে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন অনেকেই৷ দুইটি উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর মাহমুদুল হককে নিয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক মহলে সাড়া পড়ে গিয়েছিল৷ কলকাতার 'দেশ' পত্রিকা লিখেছিল, এই লেখক বাংলা গদ্যকে শাসন করার ক্ষমতা রাখে৷ কিন্তু এসব কথা তাঁকে টানেনি৷ তাঁর সাথে কথাবার্তা বলতে গিয়ে লেখার প্রসঙ্গ এলেই তা তিনি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন৷ যশ ও খ্যাতি তিনি পেয়েছিলেন, কিন্তু সেসবের মায়া তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি৷ লেখালেখি তাঁর নেশা বা পেশা কোনোটাই ছিল না৷ তিনি বলতেন, 'লেখালেখি ছিল নিতান্ত শখের ব্যাপার৷ এটা আমার পেশা নয়৷ এ দিয়ে আমার পয়সাও হয়নি৷ এই করে আমি খাইওনি৷'
নিজের লেখা সংরক্ষণের মানসিকতাও তাঁর ছিল না৷ একবার 'এলাকা' নামের একটি বিশাল উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলেন তিনি৷ প্রথম লেখা উপন্যাস ছিল সেটাই৷ সারাজীবন ধরে এ লেখাটি লিখবেন বলে স্থির করেছিলেন৷ লিখেছিলেনও হাজার পৃষ্ঠার মতো৷ ৩০ থেকে ৩৫ বছর ধরে লিখেছিলেন সেটি৷ অযত্নের কারণে এই বিশাল লেখাটি ক্ষুদ্র উইপোকার দীর্ঘদিনের খোরাক হয়েছে৷ খাটের নিচে পড়েছিল দীর্ঘদিন৷ বাড়ি বদলানোর সময় দেখেন উইপোকা একেবারে শেষ করে দিয়েছে৷ মীজানুর রহমানের (ত্রৈমাসিক খ্যাত মীজানুর রহমান) সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর বন্ধুত্ব৷ মীজানুর রহমান তখন 'রূপছায়া' নামের একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদক৷ ওই পত্রিকায় ছাপতে দিয়েছিলেন 'দ্রৌপদীর আকাশে পাখি' নামের একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস৷ পত্রিকাটির ওই সংখ্যা পরে আর ছাপা হয়নি৷ নিতান্ত অবহেলার কারণে সেই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিও হারিয়েছেন তিনি৷ 'পাতালপুরী' নামের একটি উপন্যাস ছাপা হয়েছিল 'রোববার' পত্রিকায়৷ আশি সালের দিকে লেখা সেই উপন্যাসেরও কোনো খোঁজ তিনি নেননি৷ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত অনেক গল্প লিখেছেন তিনি৷ সেসবেরও কোনো খবর রাখেননি৷
নিজের লেখার প্রতি অযত্ন থাকলেও বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত-অপরিচিতের প্রতি বিশেষ যত্নবান ছিলেন মাহমুদুল হক৷ যাঁরাই তার কাছাকাছি গিয়েছেন তাঁরাই বুঝতে পেরেছেন আপাত এড়িয়ে চলার মানসিকতার আড়ালে কী বিশাল একটা মন ছিল তাঁর৷ ষাট ও সত্তরের দশকে বন্ধুদের আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন মাহমুদুল হক৷ আশির মাঝামাঝিতে নিজেকে সবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার পর লেখালেখির মানুষজনকে সহজে কাছে ঘেষতে দিতেন না তিনি৷ কিন্তু একবার কোনোভাবে তাঁর সঙ্গে বসতে পারলে তিনি সব ভুলে যেতেন৷ নিজেকে উজার করে দিতেন তখন৷
জীবনের শেষ দিকে এসে নির্মল সুন্দর এক আধ্যাত্মবাদের ভিতর নিমগ্ন হয়ে পড়েছিলেন তিনি৷ সেই আধ্যাত্মবাদে ধর্মীয় গোঁড়ামির লেশ ছিল না৷ নিজেকে বিশুদ্ধ মানুষ হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন তিনি৷ জীবনের শেষের অনেকগুলো বছর তিনি ছিলেন জিগাতলা নতুন রাস্তার ওপরে একটি ভাড়া বাড়ির দোতলায়৷ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিদিন দেখতাম রাস্তার পাশের মলিন সেই চারতলা বাড়ির দোতলার ফ্ল্যাটের বারান্দায় একটি পাখির খাঁচা ঝুলছে৷ খাঁচায় কয়েকটি বিভিন্ন রঙের ছোট পাখি ছিল৷ পাখিগুলো সত্যিকারের পাখি কি না তা বোঝা যেত না৷ কোনো কিচির-মিচির নেই, কোনো নড়াচড়া নেই- শুধু চুপচাপ বসে থাকত৷ খুব হঠাত্ দেখা যেত নীল ফতোয়া পড়া মাহমুদুল হককে সেই বারান্দায়৷ ২০০৭ সালে স্ত্রী হোসনে আরা মাহমুদ কাজলের মৃত্যুর পর তাঁকে প্রায় দেখাই যেত না৷ ২০০৮ সালের জুন মাসে তাঁকে খুঁজতে গিয়ে দেখি তিনি ওই বাসায় নেই৷ কোথায় গিয়েছেন- ওই বাসার কারও কাছে সে হদিশও নেই৷ মৃত্যুর খবর প্রকাশের আগের দিন পর্যন্ত কেউ আমাকে তাঁর ঠিকানা জানাতে পারেননি৷
সন্তানদের হাতে রাজ্যভার দিয়ে মহাভারতের ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির পাণ্ডবদের নিয়ে যাত্রা করেছিলেন মহাপ্রস্থানের দিকে৷ হিমালয় পর্বতে যাওয়ার পথে একে একে সবাইকে হারিয়েছিলেন তিনি৷ সবশেষে হারিয়ে ছিলেন দ্রৌপদীকে৷ প্রাণপ্রিয় স্ত্রী কাজলকে হারিয়ে মহাপ্রস্থানের দিকে নিঃসঙ্গ যাত্রা করেছিলেন মাহমুদুল হকও৷
(এই লেখাটির জন্য তথ্যসহযোগিতা নেওয়া হয়েছে মফিদুল হক, মাহবুব সাদিক, বেলাল চৌধুরী, প্রশান্ত মৃধা, হামিদ কায়সার, দিলওয়ার হাসান প্রমুখের লেখা থেকে৷ ২০০৮ সালের ২৫ জুলাই শুক্রবার প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীতে তাঁরা মাহমুদুল হককে নিয়ে যেসব লেখা লিখেছেন সেসব লেখা তথ্যের প্রয়োজনে ক্ষেত্রবিশেষে কার্যকরী হয়েছে৷ তাঁদের সবার কাছে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা)
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
জন্ম
মাহমুদুল হকের জন্ম ১৯৪০ সালে (২ অগ্রহায়ণ ১৩৪৮) ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বারাসাতে৷ বাবা সিরাজুল হক ছিলেন অর্থ বিভাগের উপ-সচিব৷ মা মাহমুদা ছিলেন গৃহিণী৷ ১৯৫০ সালে মাহমুদুল হকের বাবা ঢাকায় চলে আসেন৷ দশ ভাইবোনের মধ্যে মাহমুদুল হক ছিলেন চতুর্থ৷
পড়াশুনা
১৯৫৭ সালে ঢাকার ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৫৯ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন৷ পরবর্তীতে জড়িয়ে পড়েন ব্যবসায়৷
পরিবার
মাহমুদুল হক ও হোসনে আরা কাজল দম্পতির দুই সন্তান৷ ছেলে শিমুল হক সিরাজী টোকন ও মেয়ে তাহমিনা মাহমুদ মলি৷ টোকন থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে আর মলি কানাডায়৷
গ্রন্থ
মাহমুদুল হকের গ্রন্থাকারে প্রকাশিত উপন্যাস 'অনুর পাঠশালা', 'জীবন আমার বোন', 'নিরাপদ তন্দ্রা', 'খেলাঘর', 'কালো বরফ', 'অশরীরী', 'মাটির জাহাজ'৷ প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ 'প্রতিদিন একটি রুমাল' ও 'মাহমুদুল হকের নির্বাচিত গল্প'৷ এছাড়া ছোটদের জন্য লেখা তাঁর উপন্যাস 'চিক্কুর কাবুক'৷ কিছু অনুবাদও করেছিলেন তিনি৷ প্রকাশিত অনুবাদ গ্রন্থ চারটি৷ মাহমুদুল হকের অগ্রন্থিত লেখার মধ্যে রয়েছে শতাধিক গল্প ও অনত্মত দুটি উপন্যাস৷ এগুলো বাংলাদেশের পত্রিকায় ছাপা হয়েছে৷ উপন্যাস দুটি হচ্ছে 'দ্রৌপদীর আকাশে পাখি' ও 'পাতালপুরী'৷
পুরস্কার
বাংলাসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন মাহমুদুল হক৷
মৃত্যু
২০০৮ সালের ২১ জুলাই তিনি মারা যান৷
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment